গুজরাত ফাইলস
এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ময়নাতদন্ত
রানা আইয়ুব ভূমিকা: বিচারপতি বি.এন. শ্রীকৃষ্ণ
জীবন বাজি রেখে দীর্ঘ আট মাস ধরে এক অন্তর্তদন্তের পথে যাত্রা করেছিলেন সাংবাদিক রাণা আইয়ুব। তারই ফসল এই গুজরাত ফাইলস। অন্তর্তদন্তের বিষয়বস্তু ছিল গুজরাত দাঙ্গা, ভুয়ো সংঘর্ষে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা এবং গুজরাতের গৃহমন্ত্রী হরেন পাণ্ডিয়ার হত্যার রহস্য। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর কিনারা ধরে চলতে চলতে অসংখ্য চমকপ্রদ তথ্য তুলে এনেছেন লেখিকা।
২০০১-১০ সালের মধ্যে যে-সব আমলা ও পুলিশকর্তা গুজরাতের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন, ছদ্ম পরিচয়ে গোপনে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাণা। তাঁর অনুসন্ধান দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপারধে জড়িত থেকেছে গুজরাত রাজ্য প্রশাসন আর তার কার্যকর্তারা। আমরা জানতে পারি নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের গুজরাত থেকে দিল্লির মসনদ অভিমুখী যাত্রাপথকে কীভাবে মসৃণ করে তুলেছিল এইসব ঘটনা। তদন্ত কমিশনের সামনে যে-সব কার্যকর্তার স্মৃতিভ্রংশতা দেখা দিয়েছিল, তাঁদেরই বয়ানে উন্মোচিত হয়েছে এক নির্মম ও ভয়াবহ সত্য ।
এ-বইয়ের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। আজকের রাষ্ট্রপোষিত অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষিতে বইটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
কি রয়েছে এই বইয়ে, আসুন ভূমিকাটি পড়ে দেখি।
ভূমিকা
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যসাপিহিতং মুখ্যং ।
তত্ত্বং পূষ পাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
সত্যের মুখ আবৃত আছে সোনার পাত্রে;
হে পূষণ, সত্যময় ধর্মের দর্শনের জন্য তা অনাবৃত করো।
—ঈশভাষ্যোপনিষদ
মার্ক টোয়েন বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, ‘গল্পকাহিনির চেয়ে সত্য বিচিত্রতর, কিন্তু তার কারণ হল গল্পকাহিনিকে কিছু সম্ভাব্যতার মধ্যে আটকে থাকতে হয়, সত্যের সে বালাই নেই।’তবে সত্যের প্রকৃতি কী সে-প্রশ্ন বহু যুগ ধরে ভাবিত করেছে সারা পৃথিবীর দার্শনিকদের। খ্রিস্টের শেষ ভোজের সময় যে-থালায় খ্রিস্টের রক্ত ধরা হয়েছিল, তার মতোই সত্যকেও বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখেছেন। একাগ্রচিত্তে সত্যকে খুঁজতে চাইলে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাময় নিঃসঙ্গ পথ ধরেই চলতে হবে, কারও কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে না, পথ দেখানোর জন্য থাকবে শুধু নিজের বিবেক।
গুজরাতের ২০০২ সালের মর্মান্তিক ঘটনা এবং ভুয়ো সংঘর্ষের কল্পকাহিনি সম্পর্কে এই বইতে বর্ণিত সত্য পড়ে চমৎকৃত হতে হয়। লেখিকার মতে, এক দীর্ঘ স্টিং অপারেশনের সময় বহুল ব্যবহৃত একটি গোপন ক্যামেরা ও একটি গোপন মাইক্রোফোনের সূত্রে প্রাপ্ত বিষয়গুলি উপস্থাপনকারী এই বই থেকে এ-বিষয়ে বহু কিছু জানতে পারবেন পাঠক। এই বইতে উপস্থাপিত বিষয়গুলি সত্য নাকি নিছকই ঘটনার আপাত রূপমাত্র, তা বিচারের ভার পাঠকের।
ঘটনার বিবরণের মধ্যে গ্রথিত কথোপকথনগুলি পড়তে চমৎকার লাগে। এখানে বর্ণিত তথ্যগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা বিচার করা এবং আইনের শাসনের প্রতি দেশের নাগরিকদের আস্থা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিজের প্রহরী হিসেবে আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক কাঠামোকে ব্যবহার করাটা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মুম্বইয়ে যে-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসাত্মক ঘটনাগুলি ঘটেছিল, সে-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সূত্রে অর্জিত যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা এবং এই ধরনের দাঙ্গার শিকারদের প্রতি স্পষ্টত প্রতীয়মান উদাসীনতা দেখে মনে হয়, রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক কার্যকর্তাদের এখনই এইসব দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধানে আরও গুরুত্ব দিতে হবে এবং পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এই বইতে বর্ণিত সমস্ত তথ্য যথার্থ কিনা তার মূল্যায়ন করা সবার পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু লেখিকা যা সত্য বলে মনে করেছেন তার মুখোশ উন্মোচনের জন্য তাঁর সাহস ও তন্নিষ্ঠতার প্রশংসা করতে প্রত্যেকেই বাধ্য হবেন। তাঁকে এবং অন্তর্তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর সাহসী প্রচেষ্টাকে আমি সম্মান জানাই। ক্রমবর্ধমান অসততা, প্রতারণা ও রাজনীতিকীকরণের এই যুগে এ-ধরনের সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তাও ক্রমশই বেড়ে উঠেছে।
মুম্বই
১১ এপ্রিল, ২০১৬
বি.এন. শ্রীকৃষ্ণ
0 Comments