রাজপ্রতারক
ভাওয়াল কুমারের আশ্চর্য ও সর্বজনীন ইতিহাস
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মুখবন্ধ
এই বই একটি ঐতিহাসিক আখ্যান। এর বিষয়বস্তু এক অভূতপূর্ব মামলা। ১৯৩০-এর দশকে সেই মামলা বাংলায় রীতিমতো সাড়া জাগিয়ে তুলেছিল। এতটাই, যে ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও তার খবর পৌঁছেছিল, লেখালেখি হয়েছিল তাকে ঘিরে। মামলার কেন্দ্রে ছিল পূর্ববাংলা, অধুনা বাংলাদেশের এক নামজাদা পরিবার। আর মামলার প্রকাণ্ড জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার থেকে আমলা, পুরোহিত থেকে বেশ্যা, সৈন্য থেকে শিল্পী, অধ্যাপক থেকে সাধুসন্ত— সবাই। জড়িয়ে পড়েছিলেন শয়ে শয়ে চাষি। উকিল আর বিচারপতিদের কথা বাদই দিলাম। সাক্ষীরা শুধু বাংলা থেকে আসেনি, এসেছিল নেপাল আর পঞ্জাবের মতো দূরদূরান্ত প্রদেশ থেকেও। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ ইউরোপীয়, মূলত স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের লোক৷ উপনিবেশের শেষের দিকে বাংলার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে ইউরোপীয়রা শাসন করত, এরা তাদেরই অংশ। যে ঘটনাকে নিয়ে এই মামলা তা ঘটে ১৯০৯ সালে। আর বিচার আর আপিলের পর্ব চুকতে ঢুকতে ১৯৪৬। আমার ইতিহাস-আখ্যান তাই বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে অবস্থিত।
এ-বই আবার ঐতিহাসিক আখ্যান প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনার বইও বটে। অন্তত তিন প্রজন্ম ধরে ঐতিহাসিকেরা চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের শৈলীকে আরও শাণিত করে বিদ্যাচর্চার বাজারে এমন সামগ্রীর জোগান দিতে যা সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত যুক্তিবদ্ধ, অথচ আলংকারিক দিক দিয়ে সরল লেখনীর সমকক্ষ হতে পারে। কিন্তু গত দুই দশকে চাকা উলটোদিকে ঘুরে গেছে। ঐতিহাসিকেরা আজ হেডেন হোয়াইট অথবা মিশেল দ্য সের্তোর মত মেনে নিয়েছেন। তাঁরা স্বীকার করছেন যে সবচেয়ে বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাস রচনাতেও আলংকারিক কথনভঙ্গির একটা বড় ভূমিকা থেকেই যায়; তা অস্বীকার করা মানে নিজেকেই ঠকানো। এই নতুন আত্মোপলব্ধির ফলে কিন্তু অনেকে আবার একটা অলস সংশয়বাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন— যেন ইতিহাস আর উপন্যাসের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তাঁরা বলছেন, ইতিহাস রচনা গল্প লেখার সমগোত্রীয়, কারণ দুয়েতেই আলংকারিক গদ্যের সাহায্যে সত্যের প্রতিকৃতিমাত্র সৃষ্টি করা হয়।
সাম্প্রতিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে কার্লো গিনজবার্গ ঐতিহাসিক আখ্যানের বদলে প্রমাণকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দিয়ে চলেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ইতিহাস কেবল ঘটনার প্রতিচ্ছবি নয়, তার উদ্দেশ্য হল জ্ঞান অর্জন করা। এই কথাটা তিনি বলছেন কোনও সরল বা একগুঁয়ে প্রত্যক্ষবাদ থেকে নয়। বরং তিনি এমন একটা জমি প্রস্তুত করতে চাইছেন যেখানে দাঁড়িয়ে ইতিহাসবিদ তাঁর নিজের কৃৎকৌশল ব্যবহার করে পাঠককে বোঝাতে পারেন যে তাঁর বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্য। ইতিহাসবিদ পাঠককে ধোঁকাও দেবেন না, আবার ঔপন্যাসিকের মতো কল্পকাহিনিও রচনা করবেন না। বিশেষ করে গোয়েন্দা এবং বিচারকের সঙ্গে ঐতিহাসিকের পদ্ধতির তুলনা করেছেন গিনজবার্গ। এঁদের তিনজনের কাজই সত্য খুঁজে বার করা, আর তাঁদের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন একটা যথোপযুক্ত প্ৰকাশভঙ্গি।
গিনজবার্গের প্রতর্ক বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ এই বইতে আমার হবে। তাঁর মত যে আমি সম্পূর্ণ মানি, এমন নয়। কিন্তু অতীতকে পুনর্গঠন করতে গিয়ে বিচারবিভাগীয় পদ্ধতি আর ঐতিহাসিক পদ্ধতির মধ্যে তুলনা করার দরকার আমার পড়বে। যে দুটো পরস্পরবিরোধী বয়ান আমাদের সামনে হাজির হবে, তার মধ্যে কোনটা সত্যি? ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার বিচারকরা এমনই এক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ সমস্যার সঙ্গে ইতিহাসবিদরা আগে থেকেই পরিচিত। কিন্তু ইতিহাসবিদরা কি বিচারকদের বিচার করতে পারেন? লন্ডনে বিচারপতিরা তাঁদের শেষ রায় ঘোষণা করে দেওয়ার অর্ধশতক পরে আমি কি মামলার আর একটা শুনানির ব্যবস্থা করতে পারি? ভান করতে পারি যে, এইটা আদালতের আরেকটা আপিল? গিনজবার্গ বলবেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি অমত করব না। সেই শুনানির বন্দোবস্ত করতে, ঘটনার নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে আমি আমার আখ্যানে লেখকের মধ্যবর্তিতা একেবারে কমিয়ে এনেছি। এই আখ্যান সম্পূর্ণ তথ্যের ওপর ভর করে তৈরি হয়েছে, যে তথ্যের নির্দিষ্ট উৎস আছে। তথ্যের ফাঁকগুলো পূরণ করা হয়নি, এবং আন্দাজে বলা কথাকে যথাসম্ভব কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে কী, প্রত্যক্ষবাদী ইতিহাস রচনার সমস্ত নিয়ম একেবারে অনুপুঙ্খভাবে মেনে চলা হয়েছে।
এর ফলে আমার আখ্যানটা এমন দাঁড়িয়েছে যে সত্যটা কী, তা হয়ে গেছে অনির্ণেয়। আমি জানি, একটা প্রশ্ন আমায় প্রতিটি পাঠকই করবেন। সে-কথা আন্দাজ করে আমি শুরুতেই বলে রাখি যে, চার বছরের ওপর ভাওয়াল মামলার বিপুল নথিপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পরে, তিনটে আদালত এই মামলার ফরিয়াদি পক্ষে রায় দিয়েছিল জানার পরেও, আমি সংশয়বাদী। আমি জানি না, যে-সন্ন্যাসী ১৯২১ সালে ঢাকায় আবির্ভূত হন, তিনি প্রকৃতই ভাওয়ালের মেজোকুমার ছিলেন কিনা, যিনি তখনও পর্যন্ত জানা খবর অনুযায়ী ১৯০৯ সালে দার্জিলিঙে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তিনটে আদালতের বিচারকদের বিচারপদ্ধতি আমার পক্ষে যুক্তির সাহায্যে যতটা নির্মোহভাবে পরখ করে দেখা সম্ভব, সত্যকে যতরকমভাবে যাচাই করা সম্ভব, সেই সমস্ত কিছু দেখার পরেই এই কথা বলছি। আমার ধারণা, প্রকৃত সত্য খুঁজে না পাওয়ার কারণ আমার পদ্ধতি। যদি ভাওয়াল মামলার ওপর আমি একটা উপন্যাস লিখতাম, তা হলে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প ফাঁদার, আরও সন্তোষজনক উপসংহার টানার স্বাধীনতা আমার থাকত। অন্যদিকে, আমি যে বিচারকদের আসনে নেই, সেটা আমার পক্ষে অনেকখানি স্বস্তি। ইতিহাসবিদদের মতো দ্ব্যর্থব্যঞ্জক উপসংহারে কাহিনি শেষ করার বিলাসিতা তাঁদের নেই। মামলা প্রমাণ হোক আর না হোক, রায় তাঁকে দিতেই হবে।
আত্মপরিচয়ের দার্শনিক সমস্যাগুলোর দিকেও নির্দেশ করে আমার গল্প। কিন্তু বিশ্লেষণবাদী দার্শনিকদের পছন্দসই মনগড়া কোনও রাস্তায় নয়। বরং বিশ্লেষণবাদী দার্শনিকদের বিশ্লেষণপদ্ধতির যে অবিমিশ্র বিমূর্ততা, আমার গল্প তার ঠাসবুনোট ‘সত্য ঘটনা’র বয়ান দিয়ে তারই মোকাবিলা করেছে। এই মোকাবিলার পথে, মাঝেমাঝে আমি ডেরেক পারফিটের মতো দার্শনিকের বিপ্লবী আবেদনের ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলেছি প্রায়। আমাদের সংস্কৃতিজাত কাণ্ডজ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ডেরেক পারফিট বলেন, আত্মপরিচয়ে কী আসে যায়! যদিও, শাসনযন্ত্রের যে বিপুল ক্ষমতা আমাদের আত্মপরিচয়কে অনুমোদন করে, তার শ্রেণিবিন্যাস করে, তাকে নির্মাণ করে ক্ষমতাকে অন্যান্য সময়ে আমায় স্বীকার করে নিতেই হয়েছে। আমার গল্পের সেই আত্মপরিচয়ের সত্যতা শুধুমাত্র দার্শনিক অনুসন্ধিৎসা নয়, তা তদন্তজাত জ্ঞান। আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে, ফরিয়াদি পক্ষ নিজেকে যে লোক বলে দাবি করছে, সে আদৌ সেই লোক কিনা। আমার তাই মনে হয়েছে, সত্যের বিশ্লেষণে দার্শনিকদের প্রস্তাবিত মানদণ্ডের সঙ্গে সত্যের সাংস্কৃতিক ইতিহাস মেলে কিনা, সেটা দেখা দরকার।
তুলনায় গৌণ ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়েই এই গল্পের কারবার। যেসব চরিত্ররা সাধারণত পেশাদারি ইতিহাসবিদদের ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। ভাওয়াল মামলা নিয়ে সাংবাদিক, পুস্তিকাকার, বটতলার লেখকেরা লেখালেখি করেছেন অনেক। কিন্তু এই নিয়ে আগাগোড়া অ্যাকাডেমিক ইতিহাসের বই এই প্রথম৷ আমার গল্পের গতিপথের পেছনে নির্দিষ্ট কিছু বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া কাজ করেছে। আমি দেখাতে চাইব সেটাই। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদ আর ঔপনিবেশিকতামোচনের যুগ্ম প্রক্রিয়া। ব্রিটিশ ভারতের হাত থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের সার্বভৌম রাষ্ট্রদুটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে ঐতিহাসিক ঘটনা, যাকে রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ রাজপুরুষ আর ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভেতর সংঘটিত সাংবিধানিক সমঝোতা হিসেবে দেখা হয়, তার এক গোপন ইতিহাস লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের শরীরেই। আশা করি দেখাতে পারব সেই গোপন ইতিহাসও। যুদ্ধের আগের দশক হচ্ছে সেই দশক যে সময়ে দেশশাসনের কলা রপ্ত করে নেওয়া এক ভারতীয় প্রজন্ম— এক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় প্রশাসক— পুরোপুরি ছকে নিচ্ছে জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের বাচিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক এলাকাগুলো। আমি বলব, ভাওয়ালের মামলার যেভাবে নিষ্পত্তি হয়েছিল, সেভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার কারণ এই মামলা জাতীয়তাবাদ আর ঔপনিবেশিকতামোচনের ওই গোপন ইতিহাসের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিল।
স্বায়ত্তশাসনের কাজে জাতীয়তাবাদী নির্মাণের এই মতাদৰ্শগত সীমাবদ্ধতাগুলোও ধরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। বিশেষ করে শ্রেণি এবং লিঙ্গের সীমাবদ্ধতাগুলো আমার এই কাহিনির ক্ষেত্রে জরুরি। ১৯২০ থেকে ৩০- এর দশকের মাঝামাঝি ভাওয়াল মামলা পপুলার বা বাজারি সাহিত্যের এক বিপুল ভাণ্ডারকে ইন্ধন জোগায়। সে সাহিত্য বিচারকদের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা চোখ দিয়ে এই মামলাকে দেখেছিল। উপরন্তু, আমার গল্পে এমন অনেক মহিলা চরিত্র আছেন, যাঁরা আদালতের বয়ানে যেমন বলা আছে তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভূমিকা পালন করেছিলেন। এতে অভিজাত আইনি পরিসরের বাইরে একটা বিকল্প দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়, যেখান থেকেও গল্পটা বলা যায়।
আমি মানি যে, সরকারি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ফলে ব্যক্তিজীবনে যে প্রবল ধাক্কা সামলাতে হয়, তার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যের প্রশ্নে ইতিহাসবিদ নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। সত্যকে তিনি সবসময়েই খুঁজে বার করতে পারবেন কিনা, সেটা অবশ্য আলাদা প্ৰশ্ন৷
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর বিচারের ছাব্বিশ খণ্ড সাক্ষ্যপ্রমাণের নথির ঠিক কুড়িটা কপি হাইকোর্টের শুনানির আগে ছাপা হয়েছিল। আমি সেই ছাব্বিশ খণ্ডের বেশিরভাগটাই দেখেছি, কিন্তু তা সময় নিয়ে পড়তে বা প্রয়োজনমতো টুকে রাখতে পারিনি। সৌভাগ্যবশত, বাংলার সংবাদপত্রে এই মামলার বিবরণ অনুপুঙ্খ ছাপা হয়েছিল। বিশেষ করে, অমৃতবাজার পত্রিকা তিন বা তারও বেশি পৃষ্ঠায়, কুড়িটারও বেশি কলাম জুড়ে প্রতিদিনের শুনানির খবর ছাপত পত্রিকার কপি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারের সংবাদপত্রের রিডিং রুমে পাওয়া যায়। আমি সেই খবরের পাশাপাশি পড়েছি কলকাতার স্টেটসম্যান-এর খবর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ঢাকা প্রকাশ৷ ঢাকার জেলা আদালত আর কলকাতা হাইকোর্টের গোটা রায় সেসময় প্রকাশিত হয়েছিল। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথের বইয়ের দোকান এইসব দুর্লভ সংগ্রহের রত্নখনি। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ওপর পুস্তিকার সবচেয়ে বড় সংগ্রহ আমি দেখেছি লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিসে। কিন্তু সরকারি আর্কাইভে এই মামলার বিষয়ে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। কোর্ট অফ ওয়ার্ডস ভাওয়ালের জমিদারি-সংক্রান্ত সমস্ত প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র তাদের আইনজীবীদের ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করে রেখেছিল। সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আদালতে পেশ করাও হয়েছে। যে ফাইল আইনজীবীদের কাছে পৌঁছয়নি, সৌভাগ্যশত সেইসব কাগজপত্র বাংলাদেশের ন্যাশনাল আর্কাইভের বিশেষ সংগ্রহের আওতাভুক্ত হয়েছে।
এই বইতে যে ছবিগুলি আছে, সেগুলো হয় ১৯৩৩-৩৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বিচার চলাকালীন প্রদর্শিত, অথবা, ১৯৪০-এ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারের সময় প্রকাশ পেয়েছিল। সবগুলোই সর্বসাধারণের সম্পত্তি।
এই বই নিয়ে কাজ করার সময় আমি পৃথিবীর বহু প্রান্তে বহু মানুষের সাহায্য পেয়েছি। ঢাকায় বাংলাদেশের ন্যাশনাল আর্কাইভে ডা. শরিফুদ্দিন আহমেদ আর মীর ফজল চৌধুরী, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ময়েজুদ্দিন আমায় পথ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের স্ট্যাটিস্টিকস বিভাগের সেক্রেটারি এবং কোর্ট অফ ওয়ার্ডের প্রাক্তন সচিব মামুন-উর রশিদও তাঁর সময় এবং জ্ঞানের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনতাসির মামুন তাঁর ঢাকার ইতিহাসের বিপুল ভাণ্ডার আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। ডা. বিনায়ক সেন এবং মৃণাল রায় আমার সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় বহু সময় ধরে হেঁটেছেন। শিরিন হক, জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর তাঁদের অসামান্য পরিবার ঢাকায় তাঁদের বাড়িতে আমায় থাকতে দিয়েছেন। এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।
লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির ওরিয়েন্টাল এবং ইন্ডিয়া অফিস রিডিং রুমের কর্মচারীদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সংগ্রহশালা যতদিন না সেন্ট প্যানক্রাসের নতুন বাড়িতে উঠে যায়, ততদিন পর্যন্ত আমার কাজের অনেকটাই হয়েছে ব্ল্যাকফ্রায়ার রোডের পুরনো রিডিং রুমে।
অ্যান আর্বারে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় আর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে এবং নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল লাইব্রেরিতে আমি অনেক আগ্রহজনক মালমশলা খুঁজে পেয়েছি।
কলকাতায় আমি যথারীতি জাতীয় গ্রন্থাগার ব্যবহার করেছি, আর ব্যবহার করেছি সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর লাইব্রেরি। অবন্তী অধিকারী ছিলেন একজন উৎসাহী এবং অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন গবেষণা-সহায়ক। কলেজ স্ট্রিট প্রকাশনার রহস্যময় গলিঘুঁজিতে আমার পথপ্রদর্শক ছিলেন প্রয়াত নির্মাল্য আচার্য। তাঁর অকালে চলে যাওয়া আমার জীবনে এক বিরাট শূন্যতা এনে দিয়েছে। গৌতম ভদ্র তাঁর ঐতিহাসিক তথ্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে ক্ৰমাগত অমূল্যধন জুগিয়ে গেছেন। শিলাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ বসু, সাজেদা মোমেন আর সৌগত রায় নানাভাবে সাহায্য করেছেন। অঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী এই বইয়ের জন্য মানচিত্র এঁকে দিয়েছেন। মহাম্মদ ইকবাল শেখ বিভিন্ন স্ক্যান-করা ছবি প্রকাশের জন্য সম্পাদনা করে দিয়েছেন। কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ আমার সহকর্মীরা এই বইয়ের খসড়া পড়ে মন্তব্য করেছেন এবং আমায় গবেষণা চালিয়ে যেতে সবরকম সাহায্য আর উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা নিয়ে তাঁদের স্মৃতি বিস্তারিতভাবে আমায় বলার জন্য আমি বিশেষ করে কৃতজ্ঞ মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়, টি. কে. বসু, অদিতি মুখোপাধ্যায় আর সুনীল মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তার মহামূল্যবান সাহায্যের জন্য আমার স্ত্রী গৌরীকে ধন্যবাদ। জাত রুকুন আডবাণী, নিকোলাস ডার্কস, অমিতাভ ঘোষ আর জ্ঞান প্রকাশ এই বইয়ের শেষ খসড়াটা পড়ে অসংখ্য খুঁটিনাটি মন্তব্য করেছেন। তাঁদের সেই মহামূল্যবান মন্তব্যগুলো এই বইয়ের চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করায় বিশেষ কাজে লেগেছে। তাঁদের সময়জ্ঞান আর উৎসাহের বদান্যতায় আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। মুজাফ্ফর আলম, জানকী বাখলে, রিচার্ড বার্নস্টিন, আকিল বিলগ্রামি, দীপেশ চক্রবর্তী, মেখঠিল্ড গুহ, রণজিৎ গুহ, তপতী গুহঠাকুরতা, ভি. নারায়ণ রাও, ক্যারল রোভেন আর সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম পাণ্ডুলিপির বিভিন্ন অংশ পড়ে মন্তব্য করেছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জেনিফার ডিওয়ান একজন অসামান্য গবেষণা-সহায়ক, উমা ভৃগুবান্দা ইনডেক্স তৈরি করে দিয়েছেন এবং অর্জুন মাহে, বিষ্ণুপদ মিশ্র আর রবি শ্রীরামচন্দ্রন তাঁদের মূল্যবান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজে আমার সহকর্মীরা আমার বিদ্যাচর্চায় দীর্ঘদিনের সহচর, তাঁদের উৎসাহ আর সমালোচনা নানাভাবে আমার কাজকে উন্নত করেছে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেসের মেরি মারেল, ফ্রেড অ্যাপেল, টিম সালিভান আর মার্গারেট কেস এবং পার্মানেন্ট ব্ল্যাক-এর রুকুন আডবাণী ছিলেন এই বইয়ের উৎসাহী সমর্থক, এই বই প্রকাশের জন্য তাঁদের সাহায্য অপরিহার্য ছিল। এই বইয়ের শেষ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয় আমি বার্লিনের ভিসেনশাফটসকোলেগে ফেলো থাকাকালীন। সেখানকার সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডাগুলো যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি পরিপুষ্ট করেছে তথ্যের ভাণ্ডার। পাশাপাশি সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগসুবিধা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মীদের দৌলতে অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং মূল্যবান সহায়তাও পেয়েছি।
যখন এই বই ছাপতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন আবিষ্কার করলাম যে বিচারের সময় যেসব ফোটোগ্রাফ প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছিল, সেই ছবির বাক্সটা ইব্রাহিম আলকাজি লন্ডনের এক নিলাম থেকে ১৯৯৭ সালে উদ্ধার করেন। সেটা রাখা আছে নিউ ইয়র্কে তাঁর ফোটোগ্রাফি সংগ্রহে। দুর্ভাগ্যবশত, সেই খবর আমার কাছে এত পরে পৌঁছল যে সেই অত্যাশ্চর্য সংগ্রহের আমি পূর্ণ ব্যবহার করতে পারলাম না। এই ছবিগুলো আমার ব্যবহারের জন্য কপি করতে সহায়তা করার জন্য আমি আলকাজি এবং সিপিয়া ইন্টারন্যাশনালের এসা এপস্টাইনের কাছে কৃতজ্ঞ। অনুপমা রাও-এর কাছেও কৃতজ্ঞ, কারণ তিনিই এই সংগ্রহের সন্ধান দিয়েছিলেন। প্রচ্ছদ এবং ৩, ৫ আর ৮ নম্বর ছবিগুলি আলকাজি কালেকশন অফ ফোটোগ্রাফি-র সৌজন্যে।
0 Comments