Ticker

6/recent/ticker-posts

শহরতলির উদ্বাস্তু-কলোনি: এমন একটি বইয়ের প্রয়োজন ছিল।

শহরতলির উদ্বাস্তু-কলোনি আত্মপরিচয় নির্মাণের আখ্যান (১৯৪৭-১৯৭৭)

 

বিমান সমাদ্দার

শহরতলির উদ্বাস্তু-কলোনি আত্মপরিচয় নির্মাণের আখ্যান (১৯৪৭-১৯৭৭)

মুখবন্ধ— শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়

দমদম হরকালি কলোনির প্রথম প্রজন্মের এক বয়স্কা উদ্বাস্তু গৃহকর্ত্রী পূর্ববঙ্গ থেকে এককৌটো মাটি ও একটি আমের আঁটি কেবলমাত্র নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। পূর্ববঙ্গের পুনর্নির্মাণের (re-creation) চেষ্টায় তাঁর ‘দ্যাশের মাটি’ মিশে যায় হরকালি কলোনির ওই বাড়ির উঠানে। ওই আঁটি থেকে জন্মানো আমগাছ হয়ে ওঠে ‘আমাগো দ্যাশের গাস্’। দ্রুত বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সেই গাছ কেটে ফ্ল্যাটবাড়ির নির্মাণ আজ বাস্তব। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দখল করা জমিতে উদ্বাস্তুরা যে বাসগৃহ ও আত্মপরিচয় নির্মাণের চেষ্টা করেছিল, বর্তমানে তা ক্রমবিলীয়মান। সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে উদ্বাস্তু আন্দোলনের জটিল ও নিবিড় সম্পর্ক, উদ্বাস্তুদের খন্ডিত আত্মপরিচয়, উদ্বাস্তুদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে 'কলোনি' ও ‘উদ্বাস্তু’সত্ত্বাকে বর্জনের প্রচেষ্টার ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণামূলক গ্রন্থে।

আমি ঐতিহাসিক নই, ইতিহাস সৃষ্টির ক্ষমতাও ছিল না আমার। বৃহৎ ইতিহাসের দ্বারা অসহায়ভাবে নিয়ন্ত্রিত এক নগণ্য মানুষ হিসেবেই জীবন কাটিয়েছি। ... সাধারণ পাঠক হিসেবে বলি, তাঁর এই গবেষণার বিস্তার এবং গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে, এবং দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের এই মর্মান্তিক খণ্ডটির নানা মাত্রা- সরকারি প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলি, ইতিহাসের ক্রীড়নক ওই মানুষগুলি সমস্ত পক্ষই তাঁর আহরণ ও বিশ্লেষণে সজীব হয়ে উঠেছে। গবেষণা হিসেবে এটি যেমন সার্থক, তেমনই মানবিক দলিল হিসেবেও মূল্যবান হয়ে উঠেছে। অন্তত এইটুকু আমি বলতে পারি, পাঠকের দায়িত্ব নিয়ে।

পবিত্র সরকার, প্রাক্তন উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ... তার প্রমাণ সাম্প্রতিককালে বহু গবেষণাকারীদের মধ্যে বিখ্যাত লোকও আছেন, যেমন জয়া চ্যাটার্জি প্রমুখ। তা সত্ত্বেও সাহস করে শ্রীমান বিমান এ কাজে হাত দিয়েছেন । তার আগ্রহ এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল বলেই এই সৎ সাহস দেখিয়েছেন। কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন... উদ্বাস্তু ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের বিস্তীর্ণ ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে এই ভূমিকাই উদ্বাস্তু সমস্যার অন্যতম কারণ। বিষয়টি অবশ্যই পাঠকদের আকৃষ্ট করবে।

রজতকান্ত রায়, প্রাক্তন উপাচার্য, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

স্মৃতি, শ্রুতি আর তথ্যের নিবিড় বন্ধনে ঘনিষ্ঠ, লেখক এমন একটি যন্ত্রণা-বিদ্ধ, ছিন্নমূল মানবগোষ্ঠীর জীবনকথা শুনিয়েছেন যা আখ্যানে আন্তরিক, ব্যাখ্যানে নির্মোহ । এ-গ্রন্থ স্মৃতি-কাতরতার উর্দ্ধে প্রলম্বিত, বিপর্যস্ত জীবনের এক বহুমাত্রিক মানচিত্র । 

অরবিন্দ সামন্ত, প্রাক্তন অধ্যাপক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়

দেশভাগের পরিণতিতে উদ্বাস্তু মানুষের জীবনধারা আমাদের সমাজের এক মহাকাব্য। এতে ব্যথা রয়েছে, যন্ত্রণা রয়েছে, দাঁত-চেপা লড়াই রয়েছে, ব্যক্তি থেকে সমষ্টি হয়ে ওঠা রয়েছে। রাজনৈতিক নীতি ও সংগঠনের বড় ভূমিকা রয়েছে। এই বিরাট প্রেক্ষাপটকে তথ্যনিবিড় গবেষণায় ধরা হয়েছে এই বইয়ে। এই বিষয়ের চর্চায় নতুন যাত্রা এবং সম্ভবত কিছু নতুন বিতর্কও এনে দিল এই বই। 

দেবাশিস চক্রবর্তী, সম্পাদক, গণশক্তি


লেখকের কথা

ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাড়িতে একটা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে কিছু ধান রাখা ছিল; আরেকটা বয়ামে রাখা ছিল কিছুটা ঘি। জন্মদিনে ঐ ধান আর ঘি দিয়ে মা আশীর্বাদ করতেন। তখনো বুঝতাম না কি তার তাৎপর্য। একটু বড় হতে শুনলাম ওটা নাকি দেশের বাড়ির ধান, দেশের বাড়ির ঘি। শব্দবন্ধটা কিন্তু মনে থেকে গিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে উদ্বাস্তু সত্তার বোধ কখনো ছিল না। কিন্তু অজান্তেই কিছু অনুভূতির বিকাশ ঘটেছিল। যাদবপুরে এম এ পড়ার সময় একটি সেমিনারে একজন ঐতিহাসিক পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তুদের নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে লালিত ঐ না বোঝা অনুভূতি হঠাৎ যেন বলে দিল এটাই তো আমার বিষয়, এটা নিয়েই তো কাজ করা উচিত। এরপরে এশিয়াটিক সোসাইটিতে ফেলোশিপ পেলাম। সুযোগ এল উদ্বাস্তুদের নিয়ে গবেষণা করার ৷

বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজে চাকরিতে যোগদানের আগে ফেলোশিপে ছিলাম প্রায় দুই বছর। গবেষণার কাজ ফেলোশিপ পর্বে একটা গতি ও রূপ লাভ করেছিল। কলকাতা ত্যাগ - শান্তিপুর কলেজে যোগদান প্রভৃতি ঘটনা আমার ওই গবেষণার গতিকে ছিন্ন করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শৌভিক মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে আবার ধীরে ধীরে শুরু হয় কাজে ফেরা। ভাস্কর বাবু (অধ্যাপক ভাস্কর চক্রবর্তী) তাঁর মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করে নতুন চিন্তাগুলোকে সংহত করতে সাহায্য করেন। নিজের পেশাগত জটিলতা, বিপুল ট্রেন জার্নি, প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে আজ এই গ্রন্থ যে রূপ লাভ করেছে তার কৃতিত্ব আমার সকল শিক্ষকের। তাঁদের সাহায্য, প্রশ্রয় ও প্রদেয় অবাধ স্বাধীনতা ব্যতীত এ কখনোই সম্ভব ছিল না। ধন্যবাদ জানাই আমার সকল বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীদের। আমার সমগ্র পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই সর্বদা আমার সাথে থাকার জন্য। দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি ও ডঃ মহুয়া সরকারকে ধন্যবাদ জানাই প্রাথমিক স্তরে আমাকে উদ্বাস্তু বিষয়ক গবেষণার সাথে যুক্ত করার ও পথ দেখানোর জন্য। পথ-প্রদর্শক হিসেবে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা স্তরে যে সকল শিক্ষকের স্নেহ লাভ করেছি তাঁদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।

গ্রন্থটির মুখবন্ধ লিখে যিনি এর মূল্যায়ন ও মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করলেন সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক, অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রইল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। বিশেষ শ্রদ্ধা জানাই অধ্যাপক রজতকান্ত রায়, অধ্যাপক পবিত্র সরকার ও গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশীষ চক্রবর্তী মহাশয়কে। অধ্যাপক অরবিন্দ সামন্ত এই গ্রন্থের নামকরণ, প্রচ্ছদ এবং সামগ্রিক গুণমানের বিষয়ে যেভাবে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন তার জন্য ওনার প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ জানাই আমার সহকর্মী অলোক বিশ্বাস, ছাত্ৰ প্ৰশান্ত দাস ও শুভজিৎ দাসকে। এই গ্রন্থে অশোক মুখোপাধ্যায় রচিত সংসদ বানান অভিধান, চতুর্থ মুদ্রণ, ২০১৫-র বানানবিধি অনুসরণ করা হয়েছে। আমার মূল গবেষণাকে গ্রন্থরূপে নির্মাণ করার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানাই অমিণীতা পাল- কে যিনি নিরলস পরিশ্রম করে গ্রন্থটিকে তার বর্তমান রূপে নিয়ে এসেছেন। বিশেষ ধন্যবাদ জানাই অ্যালফাবেট বুকসের ইন্দ্রনাথ পৈলান ও রাজু হাজরা যাদের উৎসাহে এই গ্রন্থটি বর্তমান রূপ লাভ করল। আমি গ্রন্থটি উৎসর্গ করছি ডঃ বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি ইহলোকে না থেকেও প্রত্যহ আমাকে আশীর্বাদ ও উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। সবশেষে বলতে চাই, এই গ্রন্থের যে কোন ত্রুটির সমস্ত দায় একান্ত ভাবে আমার।

বিমান সমাদ্দার

পিএইচ.ডি. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় 


প্রচ্ছদ চিত্র - Refugees squatting on Sealdah station in Calcutta

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - ‘They Live Again, Director of Publicity, Government of West Bengal, 1953, p. 11.

Sahortalir Udbastu-Koloni: Atmoparichoy Nirmaner Aakhyan (1947-1977) 

শহরতলির উদ্বাস্তু কলোনিঃ আত্মপরিচয় নির্মাণের আখ্যান (১৯৪৭-১৯৭৭)

প্রথম প্রকাশঃ ২০২৩

প্রকাশকঃ

অ্যালফাবেট বুকস

মূল্যঃ ৪৯৯.০০


Post a Comment

0 Comments