লাতিন আমেরিকার রক্তাক্ত ইতিহাস - এদুয়ার্দো গালেয়ানো
ইসাবেল আইয়েন্দের ভূমিকা
অনেকবছর আগে, যখন আমি যুবতী এবং তখনও বিশ্বাস করতাম যে আমাদের আশা- আকাঙ্খা অনুসারে পৃথিবীটাকে পালটে ফেলা যাবে, সেইসময়ে কেউ আমাকে এক হলদে মলাট দেওয়া একটা বই দিয়েছিল। অসহ্য আবেগে দুদিনের মধ্যে গোগ্রাসে পড়ে শেষ করেছিলাম বইটা, আর তারপরে তার সবকিছু অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য বইটা আমাকে বারবার পড়তে হয়েছে। বইটি এদুয়ার্দো গালেয়ানোর ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা'।
সত্তরের দশকের প্রথমভাগে চিলে ছিল এক ছোট্ট দ্বীপ, এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মাঝে, যার মধ্যে ইতিহাস ছুঁড়ে ফেলেছিল মানচিত্রে যাকে দেখা যায় এক অসুস্থ হৃদযন্ত্ররূপে, সেই লাতিন আমেরিকা নামক মহাদেশকে। আমাদের দেশে ছিল সালভাদর আইয়েন্দের সমাজতান্ত্রিক সরকার, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রপতি হওয়া প্ৰথম মার্কসবাদী, এমন একজন মানুষ যিনি স্বপ্ন দেখতেন সাম্য এবং স্বাধীনতার, এবং সেই স্বপ্নকে সত্যি করে তোলার জন্য ছিল তাঁর প্রচণ্ড আবেগ। সেই হলদে মলাটের বইটি অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, আমাদের অঞ্চলে কোনো নিরাপদ দ্বীপ নেই, আমরা সকলেই ভাগ করে নিয়েছি পাঁচশো বছরের শোষণ আর ঔপনিবেশিক শাসনের যন্ত্রণা, আমাদের সকলের ভাগ্যই একই সূত্রে গাঁথা। আমাদের সকলেরই একটি জাত, তা নিপীড়িতের। যদি আমি ছত্রগুলি আঁতিপাতি করে পড়তে সক্ষম হতাম, বোধহয় এই মন্তব্যটাই করতাম যে, সালভাদর আইয়েন্দের সরকারের অনিবার্য পরিণতি নিহিত ছিল সূচনা থেকেই। সেটা ছিল ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় এবং মার্কিন সরকার বামপন্থী পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনোমতেই সেই অঞ্চলে অনুমোদন করত না, যেটা হেনরি কিসিঙ্গারের কথায় তাদের “বাড়ীর পিছনের উঠান”। কিউবার বিপ্লব ছিল যথেষ্ট; আর কোনো সমাজতান্ত্রিক প্রকল্প সহ্য করা যায় না, হোক না কেন সে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলশ্রুতি। সেপ্টেম্বর ১১, ১৯৭৩-এর সামরিক অভ্যুত্থান চিলেতে শতাব্দী প্রাচীন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অবসান ঘটাল এবং শুরু হল জেনারেল আউগুস্তো পিনোচেতের দীর্ঘ শাসন। একই ধরনের অভ্যুত্থান ঘটেছিল অন্যান্য দেশগুলিতে এবং শীগগিরি মহাদেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা বাস করতে শুরু করল সন্ত্রাসের আবহাওয়ায়। এই রণকৌশল ছকা হয়েছিল ওয়াশিংটনে আর লাতিন আমেরিকান জনগণের উপরে তা প্রয়োগ করেছিল দক্ষিণপন্থী আর্থ-রাজনৈতিক শক্তি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই, ক্ষমতায় থাকা সুবিধাভোগী শ্রেণীর ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে কাজ করেছে সামরিক বাহিনী। ব্যাপকভাবে চলতে লাগল দমন পীড়ন; শারীরিক অত্যাচার, বন্দীশিবির, সংবাদ প্রকাশে বিধিনিষেধ, বিনা বিচারে আটক, মৃতুদণ্ড, এসব ছিল আকছার ঘটনা। হাজার হাজার লোক স্রেফ “অদৃশ্য” হয়ে গেল, প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে লোক উদ্বাস্তু হয়ে দেশ ছাড়ল। এতকাল এই মহাদেশ যা সহ্য করে এসেছে সেই পুরানো ও সাম্প্রতিক ক্ষতের উপরে নতুন দগদগে ঘা যোগ হল। এই রাজনৈতিক পটভূমিকায় প্রকাশিত হল ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা'। বইটি রাতারাতি বিখ্যাত করে দিল এদুয়ার্দো গালেয়ানোকে, অবশ্য ইতিমধ্যেই তিনি উরুগুয়াইতে এক রাজনৈতিক সাংবাদিক হিসাবে যথেষ্ট পরিচিত মুখ।
তাঁর সমস্ত দেশবাসীর মতো, এদুয়ার্দোও চেয়েছিলেন ফুটবল খেলোয়াড় হতে। তিনি সাধুসন্তও হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর এই অধ্যায়টা শেষ হয় সবচেয়ে মারাত্মক কিছু পাপ কাজ করার মধ্য দিয়ে; যেমন, তিনি স্বীকার করলেন, “এটা সত্যি যে, আমি কখনও কাউকে হত্যা করিনি, তার কারণ, আমার সাহস এবং সময়ের অভাব ছিল, কিন্তু এটা বলা যাবে না যে, আমার ইচ্ছার অভাব ছিল।” তিনি কাজ করতেন একটি রাজনৈতিক পত্রিকা 'মারচা'র জন্য এবং আঠাশ বছর বয়সেই উরুগুয়াইয়ের প্রথম সারির দৈনিক ‘এপোকা'-র পরিচালনার ভার পেয়েছিলেন। তিন মাসে, ১৯৭০-এর শেষ নব্বইটা রাত্রিতে তিনি ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা' লেখা শেষ করেছিলেন। তখন দিনের বেলায় তিনি কাজ করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে; বই, পত্রিকা এবং সংবাদ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
উরুগুয়াইয়ের তখন খুব দুঃসময়। প্লেন আর জাহাজ ভর্তি হয়ে দেশ ১ ছাড়ছে হাজার হাজার যুবক যারা পালাতে চাইছে দারিদ্র্য আর মাঝারি মানের জীবন থেকে, দেশ তাদের কুড়িতেই বুড়ো হয়ে যেতে বাধ্য করেছে। বিগত শত বছরের গ্রহণের পরে সামরিক বাহিনী মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে তুপামারো গেরিলাদের মোকাবিলা করার অছিলায়। স্বাধীনতার সমস্ত ক্ষেত্রগুলোকে কুরবানি দিল তারা আর নাগরিক জাত অধিকারকে পুরোপুরি উধাও করে দিল, যেটা ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল।
১৯৭৩-এর মাঝামাঝি ওখানে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হল, তাঁকে বন্দী করা হল এবং অল্পদিন পরেই তিনি আর্জেন্তিনাতে নির্বাসনে চলে গেলেন; সেখানে তিনি তৈরি করেন এক পত্রিকা ‘ক্রিসিস'। কিন্তু ১৯৭৩-এ আর্জেন্তিনাতেও ঘটল সামরিক অভ্যুত্থান এবং শুরু হয়ে গেল বুদ্ধিজীবী, বামপন্থী, সাংবাদিক আর শিল্পীদের বিরুদ্ধে “নোংরা যুদ্ধ”। গালেয়ানো আবার নির্বাসনে। এবার স্পেনে, তার স্ত্রী এলেনা ভিইয়াগ্রা সহ । স্পেনে বসে তিনি লিখলেন 'ডেজ অ্যান্ড নাইটস অব লাভ অ্যান্ড ওয়ার’, স্মৃতি নির্ভর এক অসাধারণ বই। অল্প কিছুদিন পরেই শুরু করলেন আমেরিকায় আত্মার সঙ্গে কথোপকথনের ভঙ্গিতে ‘মেমোরিস অব ফায়ার’: প্রাক-কলম্বিয়ান যুগ থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত লাতিন আমেরিকান ইতিহাসের এক বিশাল ফ্রেস্কো। “আমি কল্পনা করি যে আমেরিকা ছিল এক মহিলা, সে আমাকে কানে কানে বলে তার গুপ্ত কথা, যে ভালবাসা আর অবমাননা তাকে সৃষ্টি করেছে তার বর্ণনা দেয়।” বইটির তিনটি খণ্ড নিয়ে তিনি আট বছর কাজ করেন, হাতে লিখতেন। “আমি সময় বাঁচাতে উৎসাহী নই, আমি তাকে উপভোগ করতে পছন্দ করি।” অবশেষে, ১৯৮৫-তে, একটি গণভোটে সামরিক একনায়কতন্ত্র পরাজিত হয় উরুগুয়াইতে, গালেয়ানো দেশে ফিরতে সক্ষম হলেন। তাঁর নির্বাসন চলেছিল এগারো বছর, কিন্তু তিনি অদৃশ্য থাকতে অথবা নীরব থাকতে শেখেননি। মনতেভিদেও-তে পা রাখার দিন থেকেই তিনি আবার শুরু করলেন সামরিক জুন্টাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসা টালমাটাল গণতন্ত্রকে শক্তপোক্ত করার কাজ। কর্তৃপক্ষকে অমান্য করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একনায়কতন্ত্রের অপরাধগুলিকে ধিক্কার জানানোর কাজটাও চালিয়ে গেলেন।
এদুয়ার্দো গালেয়ানো প্রকাশ করেছেন আরও অনেক গল্প উপন্যাস আর কবিতা; অগণিত প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, এবং বক্তৃতারও লেখক তিনি; পেয়েছেন বহু পুরস্কার, সাম্মানিক ডিগ্রি এবং তাঁর সাহিত্য প্রতিভার ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার স্বীকৃতি । অগুনতি মহান সাহিত্যিকের ধাত্রীভূমি লাতিন আমেরিকার তিনি অন্যতম এক চিত্তাকর্ষক লেখক। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, রাজনৈতিক প্রত্যয়, কাব্যিক দক্ষতা এবং সুন্দর গল্প বলার কায়দা- এ সবেরই মিশ্রণ তার লেখায়। লাতিন আমেরিকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, শুনেছেন দরিদ্র আর নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর, নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের কথাও। বাস করেছেন ইন্ডিয়ান, কৃষিজীবী, গেরিলা, সৈন্য, শিল্পী, আইনভঙ্গকারী প্রমুখ সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে; কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতিদের, অত্যাচারীদের, শহীদদের, পুরোহিতদের, বীরেদের, দস্যুদের, বেপরোয়া মায়েদের এবং সহিষ্ণু বেশ্যাদের সঙ্গে। সাপে কেটেছে তাঁকে, ট্রপিক্যাল জ্বরে ভুগেছেন বারবার, জঙ্গলে হেঁটে বেড়িয়েছেন, ভয়ংকর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে ফিরেছেন। দমনমূলক শক্তি তাঁকে নিগ্রহ করেছে, করেছে উগ্র সন্ত্রাসবাদীরাও। সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং সমস্ত রকম নিষ্ঠুরতা আর শোষণের বিরুদ্ধতা করেছেন তিনি, মানবাধিকার রক্ষার কাজে অচিন্তনীয় ঝুঁকি নিয়েছেন। আমি মনে করি, অন্য যে কারও চাইতে লাতিন আমেরিকা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান অগ্রগণ্য, যা ব্যবহার করে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন এই মহাদেশের জনগণের স্বপ্ন আর মোহমুক্তি, আশা আর ব্যর্থতার ইতিহাস। সাহিত্যিক প্রতিভা নিয়ে তিনি এক অভিযাত্রী, এক সহানুভূতিশীল হৃদয় আর এক কোমল রসবোধ তাঁর মূলধন। “আমরা এমন একটা বিশ্বে বাস করি যেখানে জীবিতদের চেয়ে মৃতদের প্রতি ভালো আচরণ করা হয়। আমরা, জীবিতরা, কেবল প্রশ্নকর্তা আর উত্তরদাতা এবং যে ব্যবস্থা টাকার মতো মৃত্যুতেও বিশ্বাস করে, তাদের কাছে ক্ষমার অযোগ্য আমাদের এই গুরুতর ত্রুটি।”
এই সমস্ত প্রতিভার সমাহার তাঁর প্রথম বই 'ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা’য়, যেখানে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গল্প বলার মুন্সিয়ানা। আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এদুয়ার্দো গালেয়ানোকে। অনির্দিষ্ট কোনো এক সময়ের জন্য কোনো আপাত প্রচেষ্টা ছাড়াই ফল্গুধারার মতো বেরিয়ে আসে তাঁর গল্পের ভাণ্ডার। একবার কিউবার সমুদ্রসৈকতের এক হোটেলে আমি এবং তিনি দুজনেই আটকে পড়েছিলাম, না ছিল কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা, না কাজ করছিল শীততাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বেশ কয়েকদিন তিনি আমাকে তাঁর অত্যাশ্চর্য গল্প দিয়ে মোহিত করে রেখেছিলেন। এই প্রায় অতিমানবীয় গল্প বলার প্রতিভাই 'ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা'-কে এত সহজপাঠ্য করে দিয়েছে—যেন একটা জলদস্যুর উপন্যাস, একসময়ে এইভাবেই বর্ণনা করেছিলেন বইটিকে—এমনকি তারাও যাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ে অতটা জ্ঞান নেই, তাদের কাছেও আকর্ষণীয় বইটি। বইটিতে একটি কাহিনীর মতো অবিরত মাধুর্য আছে, পড়তে পড়তে এটি ফেলে রাখা অসম্ভব। তাঁর যুক্তি, তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর আবেগ এতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারত না যদি না সেগুলি তিনি প্রকাশ করতেন তাঁর অসাধারণ ভঙ্গিতে, যথাযথ সময়জ্ঞান এবং রহস্যের ঘেরাটোপে। আপোষহীন তীব্রতার সঙ্গে শোষণের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়েছেন গালেয়ানো, তবুও ঐক্য ও সংহতি এবং নিকৃষ্ট লুণ্ঠনের মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার বর্ণনায় বইটি প্রায় কাব্যিক। গালেয়ানোর গল্প বলার মধ্যে একটা রহস্যজনক ক্ষমতা আছে। তাঁর শৈলী ব্যবহার করে তিনি পাঠকের মনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন, তাঁর লেখার চমৎকারিত্ব ও আদর্শবাদের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করিয়ে পাঠককে প্ররোচিত করেন বইটির শেষ পর্যন্ত পড়তে।
তাঁর “Book of Embraces”-এ এদুয়ার্দোর একটা গল্প আছে যেটা আমি খুব ভালোবাসি। আমার কাছে সাধারণভাবে কোনো রচনার ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে তাঁর লেখার ক্ষেত্রে যা এক অনন্য রূপকালংকার বিশেষ।
এক বৃদ্ধ এবং একাকী মানুষ তার জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছে বিছানায় । একটা গুজব ছিল যে তার বাড়িতে কিছু লুকানো সম্পদ আছে। একদিন কয়েকটা চোর দরজা ভেঙে ঢুকে আঁতিপাতি করে সব জায়গা খুঁজে ‘সেলারে' একটা সিন্দুক খুঁজে পেল। ওটা নিয়ে তারা সরে পড়ল আর যখন সেটা খুলল দেখতে পেল চিঠিতে ভর্তি সেটা। তার দীর্ঘ জীবনে বৃদ্ধ লোকটি যত প্রেমপত্র পেয়েছে সবগুলি সঞ্চিত ছিল ওই সিন্দুকে। চোরগুলো প্রথমে চিঠিগুলো পুড়িয়ে দেবে ভেবেছিল, কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথা বলে তারা ঠিক করল ফিরিয়েই দেবে ওগুলি; একটা একটা করে, সপ্তাহে একটা। তখন থেকে, প্রত্যেক সোমবারে দুপুরবেলায় বৃদ্ধ লোকটি ডাক পিওনের জন্য অপেক্ষা করত। পিওনকে দেখামাত্র বৃদ্ধ লোকটি তার পানে দৌড়তে শুরু করত, পিওনটিও জানত ব্যাপারটা, তাই সে চিঠিটাকে হাতে করে তুলে ধরত। চাকা এমনকি সেন্ট পিটারও বোধহয় সেই হৃদস্পন্দন শুনতে পেতেন, যখন আনন্দে অধীর হয়ে লোকটি এক মহিলার কাছ থেকে একটি বার্তা পেত।
গালেয়ানোর গল্পে চিঠিগুলির অস্তিত্ব ছিল এবং প্রথমে সেগুলি ছিল বৃদ্ধ লোকটির সম্পত্তি, কিন্তু ওগুলি রাখা ছিল এক অন্ধকার সিন্দুকে, সেগুলি ছিল মৃতবৎ। সামান্য চাতুরির মাধ্যমে চিঠিগুলিকে একটি একটি করে ডাকে ফেরত পাঠিয়ে ভালোমানুষ চোরগুলি চিঠিগুলিকে দিল নতুন জীবন আর বৃদ্ধ মানুষটিকে দিয়েছিল এক নতুন মায়াঘোর। আমার কাছে গালেয়ানোর রচনায় এটাই প্রশংসার দিক—লুকানো সম্পদ খুঁজে বার করা, বিস্মৃতপ্রায় ঘটনাতেও স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করা এবং ক্লান্ত অবসন্ন প্রাণশক্তিকে তিনি সঞ্জীবিত করেন তাঁর দুর্দমনীয় আবেগ দিয়ে।
'ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা' হচ্ছে কোনো জিনিসের বাহ্যিক রূপের বাইরে উঁকি মেরে অন্বেষণের নিমন্ত্রণ। এর মতো মহান সাহিত্য জাগিয়ে তোলে চেতনা, জনসাধারণকে একত্রিত করে, তর্জমা করে, ব্যাখ্যা করে, ধিক্কার জানায়, তথ্য সংরক্ষণ করে এবং অনুপ্রেরণা দেয় পরিবর্তনকে। এদুয়ার্দো গালেয়ানোর আরও একটি দিক আমাকে চমৎকৃত করে। এই মানুষটি, যিনি এত জ্ঞানী এবং যিনি সূত্র ও লক্ষণ অনুধাবন করে গড়ে তুলেছেন অনাগত ঘটনা বর্ণনার সংবেদনশীলতা, তিনি এক আশাবাদী। ‘মেমোরি অফ ফায়ার' (মেমোরিয়াস দে ফুয়েগো)-এর তৃতীয় খণ্ড ‘সেনচুরি অব দি উইন্ড'-এর উপসংহারে, ছ’শো পাতা ধরে গণহত্যা এবং লাতিন আমেরিকার জনগণের উপর নেমে আসা নৃশংসতা, অমর্যাদা ও শোষণ, মহাদেশ থেকে যা কিছু লুণ্ঠিত হয়েছে আর যা কিছু লুণ্ঠিত হতে যাচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খপূর্ণ বর্ণনার পরে, তিনি লিখতে পারেন:
জীবনবৃক্ষ জানে যে, যা কিছু ঘটুক না কেন, তার চারধারে আবর্তিত হওয়া উষ্ণ সংগীত কখনও থেমে থাকবে না। যত মৃত্যুই আসুক না কেন, যত রক্তই বয়ে যাক, যতদিন বাতাস তাদের শ্বাস যোগাবে, ভূমি কর্ষিত হবে আর ভালোবাসবে তাদের, ততদিনই এই সংগীতের ছন্দে মানবমানবী নৃত্যে মাতবে।
গালেয়ানোর লেখায় যা আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে তা হল এই আশার হাতছানি। মহাদেশের হাজার হাজার উদ্বাস্তুর মতো ১৯৭৩-এর সামরিক অভ্যুত্থানের পরে আমাকেও দেশ ছাড়তে হয়েছিল। সঙ্গে বেশি কিছু নিতে পারিনি । অল্প জামাকাপড়, পারিবারিক কিছু ছবি, একটা ছোট্ট ব্যাগ আর আমার বাগানের একমুঠো ধুলো এবং দুটো বই। প্রথমটা পাবলো নেরুদার Ode-এর একটা পুরানো সংস্করণ আর দ্বিতীয়টা সেই হলদে মলাটের 'লাস ভেনাস আবিয়ের্তাস দে আমেরিকা লাতিনা'। কুড়ি বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরও সেই বইটা এখনও আমার সঙ্গী। এইজন্যই এই ভূমিকা লিখবার সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনি এবং সর্বসমক্ষে এদুয়ার্দো গালেয়ানোকে ধন্যবাদ জানাব স্বাধীনতার প্রতি তাঁর বিপুল ভালোবাসার জন্য এবং লেখিকা ও লাতিন আমেরিকার এক নাগরিক হিসাবে আমার সচেতনতা বৃদ্ধিতে তাঁর অবদানের জন্য। তিনি বলেছিলেন একবার—“যে সমস্ত জিনিস বিনা বেঁচে থাকা অর্থহীন, তার জন্য মৃত্যুবরণ করাও সার্থক।”
ইসাবেল আইয়েন্দ
জন্ম ১৯৪২-এর ২রা আগস্ট। চিলের রাষ্ট্রপতি সালভাদর আইয়েন্দের সম্পর্কে ভাইঝি। লাতিন আমেরিকার অগ্রগণ্যা মহিলা সাহিত্যিক। সি আই এ-র পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক অভ্যুত্থানে সালভাদর আইয়েন্দে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হলে তিনিও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। পরে দীর্ঘদিন ছিলেন ভেনেজুয়েলায়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৭-তে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যিক জীবন। বহু বিখ্যাত পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্যের সমস্ত শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। পেয়েছেন বহু সাহিত্য পুরস্কার, নিজের দেশ চিলেতে এবং বিদেশে। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ—‘এভা লুনা’ (ইভা লুনা), ‘এল প্লান ইনফিনিতো’, ‘হাউস অব স্পিরিট' ইত্যাদি। এখনও অক্লান্ত লিখে চলেছেন, তাঁর প্রতিটি নতুন লেখাই সাড়া জাগায় ইউরোপ, আমেরিকায়, লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের সর্বত্র।
0 Comments