Ticker

6/recent/ticker-posts

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক জীবনী

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাসে ও ব্যক্তিদর্পণে (১৯০৬-২০১৭)

অমিত ভট্টাচার্য সম্পাদিত। 





সৌরীন ভট্টাচার্য বলছেন, "এই বই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক জীবনী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি খুব উপযুক্ত ভাবনা। এক তীব্র ভাবাবেগ থেকে এর জন্ম। সে ছিল জাতীয়তার মুহূর্ত। বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় জাতীয় চেতনার সঙ্গে মিশেছিল দেশীয় শিক্ষার গরজ। জোর ছিল কারিগরি শিক্ষার উপরে। শিল্পোন্নত দেশের স্বপ্ন ছিল মাথায় ৷ সেই ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক নতুন পথ । জাতীয়তার থেকে এই ক্যাম্পাস একদিন পৌঁছে গেছে রাজনীতির আন্তর্জাতিকতায়। অবশ্যই মসৃণ ছিল না সে পথ। দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে মেলানো একটা গোটা রাজনৈতিক জীবন। আরও যা আছে তাও একদিন পাওয়া যাবে আশা করি।" 


অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ইতিহাস বিভাগের ইতিহাস নিয়ে নানা ধরনের তথ্যসূত্র ব্যবহার করে এই গ্রন্থে যা লিখেছেন, তা এককথায় অনবদ্য ও অভিনব। যেন আড্ডার মেজাজে সারস্বত সাধনা। এটি একটি ব্যতিক্রমী ইতিহাস, যা পাঠককে আপ্লুত করবে। ইতিহাসের দলিল হিসেবে এই গ্রন্থটি স্থায়ী আসন লাভ করবে। এমনটাই মনে করেন অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত। 


কি রয়েছে বইটিতে? 


প্রথমেই বিতর্ক, ১৯৫৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে হবে, নাকি ১৯০৬ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সূচনালগ্ন থেকে হবে? অমিত ভট্টাচার্য খেটেছেন বিস্তর। "সতীশচন্দ্র মুখার্জি দ্বারা সম্পাদিত ম্যাগাজিন Dawn and Dawn Society's Magazine-এর বেশ কিছু সংখ্যা— স্বদেশি শিল্প নিয়ে PhD গবেষণা করার সময়ে জাতীয় গ্রন্থাগারে পড়েছিলাম। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মাধবেন্দ্র মিত্র বেশ কয়েকটি খণ্ডে সেই দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় তা প্রকাশ করে। এই খণ্ডগুলি সেই যুগকে জানার জন্য একটি প্রামাণ্য সূত্র হিসাবে বিবেচিত হবে। হরিদাস ও উমা মুখার্জির লেখা The Origins of the National Education Movement, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু লেখা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের জাতীয় শিক্ষা পরিষদের দিনগুলি এবং আরও কিছু প্রবন্ধ পড়ে ফেললাম। ১৯৯২ সালে বিভাগীয় অধ্যাপক অমিতাভ মুখার্জির গ্রন্থ Fifty Years of National Education: The Story of an Experiment 1906-1956 জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থটি অনেক মৌলিক তথ্যসূত্রের উপর ভিত্তি করে লেখা এবং এই বিষয়ের উপর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তাছাড়া কিছু স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ আছে। যেমন হিমেন্দু বিশ্বাসের আমি ও আমার সময়। অধ্যাপক রমাপ্রসাদ দের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎস সন্ধানে শীর্ষক গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মুখার্জি ও জাতীয় বিদ্যালয় নিয়ে বিশেষ আলোচনা আছে। অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত তাঁর একলব্য গ্রন্থে যাদবপুরের দিনগুলির স্মৃতিচারণ করেছেন।"


অমিত ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, "গ্রন্থটি নয়টি অধ্যায়ে ভাগ করেছি। প্রথম সাতটি অধ্যায় মূলত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। ১৯০৬ সাল অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও জাতীয় শিক্ষা বিদ্যালয়ের জন্মের পর থেকে ১৯৫৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত যে অর্ধশতাব্দীব্যাপী সময়কাল সেটা প্রথম অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সময়সীমা ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬। সেটা বেড়ে ওঠার সময়, একই সঙ্গে বাইরের রাজনৈতিক আন্দোলন দ্বারা যাদবপুরের আপাত শান্ত ছাত্রসমাজকে প্রভাবিত করার সময় । স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সূচনা পর্ব সেটা । তৃতীয় অধ্যায় ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ' ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ সেটা। নকশালবাড়ির বিপ্লবী আন্দোলনের পর্যায়। চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যাদবপুরের শহিদ ছাত্রছাত্রীদের কথা। এঁদের অধিকাংশই নিহত হয়েছেন পুলিশের হাতে ভুয়ো সংঘর্ষে রাতের অন্ধকারে, কেউ বা কারাগারে রাষ্ট্রীয় ঘাতকদের আক্রমণে, কেউ বোমা বিস্ফোরণে, কেউ বা বিরোধী দলের গুন্ডাদের হাতে। যাদবপুরের তেরোজন শহিদদের মধ্যে বারোজনই নকশালপন্থী কর্মী বা সমর্থক ছিলেন। একজন ছিলেন SF কর্মী।"


"আরও একজন শহিদ হন। তিনি ছাত্র নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক গোপালচন্দ্র সেন। তিনি তাঁর অবসরগ্রহণের দিনে সন্ধ্যাবেলা সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে আততায়ীদের হাতে ক্যাম্পাসের মধ্যেই নিহত হন। অধ্যাপক জগদীশ নারায়ণ সরকার তাঁর স্মৃতিচারণে ঘটনাটিকে বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “murder in the cathedral”। প্রদীপ নারায়ণ ঘোষ তাঁর বইয়ের গোড়ায় লিখেছেন, অধ্যাপক সেন “ক্যাম্পাসের মধ্যে বাড়ি ফেরার পথে নকশালপন্থী আততায়ীদের হাতে নিহত হন।"


গ্রন্থের নাম কী হবে সে বিষয়ে নানা মতামত এসেছে। অবশেষে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে গোপা । অমিত ভট্টাচার্য জানান, "এই গ্রন্থটির লেখার কাজ অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে করতে হয়েছে। যেসব সীমাবদ্ধতা রয়ে গেল, অতিমারী-জনিত অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সেসব অতিক্রম করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই গ্রন্থটি সংবেদনশীল পাঠকেরা গ্রহণ করলে আমার প্রয়াস সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।"


Post a Comment

0 Comments