Ticker

6/recent/ticker-posts

সবক - অরুন্ধতী রায়

 সবক

অরুন্ধতী রায়

১৯৯৭ সালে প্রকাশিতগড অব স্মল থিংসই ছিল অরুন্ধতী রায়ের একমাত্র সাহিত্যকীর্তি। দীর্ঘ বিরতির পর তিনি দ্য ব্রিফিং নামে একটি খণ্ডকাহিনী প্রকাশ করেছেন। তাঁর উপন্যাসটির মতো এটিও সাহিত্যামোদী মহলের আগ্রহ কেড়েছে। দ্য ব্রিফিং হলো জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং করপোরেট রাজনীতি বিষয়ে একটি রূপক গল্প। গল্পটি এমন একটি দুর্গের পটভূমিতে রচিত হয়েছে যেটি কখনোই আক্রান্ত হয়নি। এক অজ্ঞাত সামরিক কমান্ডার এক রহস্যময় অভিযানে বাহিনী পাঠাচ্ছেন। তাদের প্রতি দেওয়া তাঁর নির্দেশনাটিই হলো গল্প। বাস্তবে দুর্গটি অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত হ্যাপসবার্গ রাজবংশের তৈরি আল্পস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। ১৮৩৩ সালে নির্মিত হওয়ার পর দুর্গটি কখনোই আক্রান্ত হয়নি। ধারণা করা হয়, নাৎসিরা তাদের লুণ্ঠিত সোনাগুলো এখানেই লুকিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি সেই দুর্গটি খুলে দেওয়া উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ গল্পটি বাজনা ও আলোসহ পঠিত হয়। গল্পটি নেওয়া হয়েছে ভারতীয় আউটলুক ম্যাগাজিনের ২৮ জুলাই সংখ্যা থেকে।

শুভ সন্ধ্যা। আপনাদের সঙ্গে নেই বলে আমি দুঃখিত। হয়তো সেটাই ভালো। এ রকম সময়ে নিজেকে খোলাখুলি করা ভালো নয়, এমনকি নিজেদের মধ্যেও না।

আপনারা আরও একটু এগোলে আরও ভালো শুনতে পাবেন। চকের দাগ খেয়াল করে দাঁড়ান। আমি জানি আপনাদের অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে এখানে এসেছেন। যা যা দেখার সবটাই কি দেখা হয়েছে? দুর্গের তলার কামানগুলো, চুল্লি, গোলাবারুদের ডিপো, গহ্বরওয়ালা মেঝে দেখেছেন? গেছেন কি মজুরদের গণকবরে? পরিকল্পনাগুলো নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখেছেন? খুবই সুন্দর না এটা, এই দুর্গ? ওরা বলে, দুর্গটা পর্বতের দুদিকে পা ছড়িয়ে বসা উদ্ধত সিংহের মতো। স্বীকার করছি, আমি নিজে কখনো এসব দেখিনি। তবে পর্যটন নির্দেশিকায় লেখা আছে, সৌন্দর্যের জন্য এটা বানানো হয়নি। কিন্তু না চাইলেও তো সুন্দর চলে আসে, আসে না? পর্দার ফাঁক দিয়ে যেমন এসে পড়ে আলোর রশ্মি, তেমনি সৌন্দর্যও এমনি এমনি চলে আসতে পারে। আহ, কিন্তু এটা এমন এক দুর্গ যার পর্দায় কোনো ফাঁক নেই, ফাটল নেই; এটা এমন এক দুৰ্গ যা কখনো আক্রান্তই হয়নি। তার মানে এর দুর্ভেদ্য দেয়াল সৌন্দর্যকেও ফিরিয়ে দেয়, ফেরত পাঠায় তার নিজ পথে?

আহ, সৌন্দর্য! আমরা সারা দিন সারা রাত এ নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি। কী এটা, কী এটা না-এটা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কার? বিশ্বের আসল জিম্মাদার কে। কিংবা আমরা কী বলব, কে আসল বিশ্বের জিম্মাদার? আসল বিশ্বটাই বা কী? আমরা যা কিছু কল্পনা, পরিমাপ, বিশ্লেষণ, নকল বা রূপায়িত করতে পারি না, তা-ই কি আসল? এমন জিনিস কি আসলেই আছে? ওগুলোর বাস কি আমাদের মনের গোপন কুঠুরিতে, কখনো আক্রান্ত না হওয়া কোনো দুর্গে? আমাদের কল্পনা যখন নিষ্ফল হবে, তখন কি জগত্ত নিষ্ফল হয়ে যাবে? কীভাবে আমরা এসব জানতে পারব বা আদৌ কি কখনো তা জানা হবে?

সুন্দর বা অসুন্দর যা-ই হোক, এই দুর্গটা আসলে কত বড়? ওরা বলে, এটা নাকি পর্বতের ওপর বানানো সবচেয়ে বড় দুর্গ। দানবীয় রকম প্রকাণ্ড, তাই না? প্রকাণ্ড জিনিস সামলানো আমাদের জন্য কিছুটা কষ্টকর। আমরা কি আগে এর নাজুকতার একটা চিত্র খাড়া করে শুরু করব? চিন্তা করে দেখুন, যদিও এটা কখনো আক্রান্ত হয়নি (ওরা তো তাই বলে), তার পরও দুর্গের নির্মাতারা দিনের পর দিন ধরে মনের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ভয় পুষে রেখেছে। নির্ঘাত তারা আক্রান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষাও করে আছে। তারা স্বপ্ন দেখে, একদিন আক্রমণ আসবে। তারা তাদের শত্রুদের মনে ও হৃদয়ে ওঁত পেতে বসে আছে। যতক্ষণ না শত্রুদের প্রতি এই গভীর ভয় তারা সরাতে পারছে, ততক্ষণ তাদের নিজেদের জন্যও কোনো কথা নেই। যতক্ষণ না তারা ত্রাস ও বাসনার পার্থক্য বুঝে উঠছে। আর তারপর, সেই আহত প্রেমের ক্ষতস্থানে বসে তাদের ধারণা হয় যে, সম্ভাব্য সব কোণা থেকে এমন নিপুণ ও মোক্ষম হামলা আসতে যাচ্ছে যে, যেন তা আসলেই আসল। এ ছাড়া এমন দুর্গ বানাবার আর কী কারণ? ভয় থেকেই এর জন্ম; এর পরতে পরতে রোপিত রয়েছে ভীতি। এই দুর্গ কি আসলেই তা নয়? ভয়ের, আশঙ্কার আর বন্দী কল্পনার এক নাজুক সাক্ষ্য এটি।

এটা বানানো হয়েছে-দুর্গের ঠিকুজির প্রধান রচয়িতাকে উদ্ধৃত করে বলছি-যা কিছু যেকোনো মূল্যে জমিয়ে রাখা উচিত, সেসবের সুরক্ষার জন্য। উদ্ধৃতি শেষ। কথাটার মধ্যে ইঙ্গিত আছে। সহযোদ্ধাগণ, ওরা এখানে কী জমা করে রেখেছে? কী তারা পাহারা দিচ্ছে?

অস্ত্রশস্ত্র। সোনা। খোদ সভ্যতা। অন্তত নির্দেশিকায় এ রকমটাই লেখা আছে।

এবং এখন, যখন ইউরোপে শান্তি ও সমৃদ্ধি, তখন এই দুর্গকে কাজে লাগানো হচ্ছে এক মহতী উদ্দেশ্যে। অথবা, আপনারা বলতে পারেন সেই তরীয় উদ্দেশতীনতায় সভ্যতার সেই অনির্বচনীয় আকাঙ্ক্ষার প্রদর্শনী-তাক হিসেবে যার নাম শিল্প। আমাকে বলা হয়েছে, আজকাল শিল্পই নাকি স্বর্ণ।

আমার মনে হয়, আপনারা সবাই দর্শনীয় জিনিসের তালিকাটি সঙ্গে এনেছেন। আনতেই হবে। অন্তত ওপরে ওপরে দেখানোর স্বার্থে।

আপনারা জানেন, এই দুর্গে সোনা থাকার সম্ভাবনা আছে। আসল সোনা। গোপন সোনা। এর বেশির ভাগটাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে, কিছুটা চুরিও গিয়েছে। কিন্তু বলা হয়, ভালো পরিমাণ সোনা নাকি এখনো মজুদ আছে। সবাই তা খুঁজছে দেয়াল ঠুকে পরীক্ষা করছে, কবর খুঁড়ে হাতড়াচ্ছে। তারা কেন এত অধীর তা নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে বোধগম্য।

তারা জানে যে দুর্গে সোনা আছে। তারা এটাও জানে যে পর্বতে আর কোনো তুষার নেই। তুষার কিনতে এই সোনা তাদের লাগবে।

যাঁরা এখানকারই লোক, তাঁরা নিশ্চয়ই তুষার যুদ্ধের কথা শুনেছেন। যাঁরা এখানকার নন, তাঁরা সজাগ হয়ে শুনুন। অভিযানের জন্য যে জায়গাটি আপনারা পছন্দ করেছেন তার হালচাল বোঝাটা আপনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

যখন থেকে এখানে শীত কমে আসছে, তখন থেকেই ‘তুষারতৈরির' দিনও কমছে এবং পরিণামে স্কি করার জন্য পর্বতের ঢালু পিঠ ঢেকে দেওয়ার মতো তুষারও আর মিলছে না। বেশির ভাগ জায়গার তুষারের ওপরই আর ভরসা করা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই এক সংবাদ-সম্মেলনে-আপনারা হয়তো সংবাদপত্রে ইতিমধ্যে তা পড়েছেনও-স্কি-চালক সমিতির সভাপতি ওয়ার্নার ভোল্ট্রন বলেছেন, 'আমার মনে হয় ভবিষ্যৎ কৃষ্ণময়, সম্পূর্ণ কৃষ্ণময়'। (ছাড়া ছাড়া হাততালি শোনা গেল, যেন পেছনের সারি থেকে তা আসছে। অস্পষ্ট গুঞ্জনও ভেসে আসে, শাবাশ! শাবাশ! বাহ, বাহ!) না না না কমরেড...কমরেডগণ, কমরেডগণ...আপনারা ভুল বুঝেছেন। জনাব ভোল্ট্রন কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগুলোর উত্থানের কথা বলেননি। কৃষ্ণ বলতে তিনি বিলীয়মান, ধ্বংসাত্মক, হতাশাজনক, বিপর্যয়কর এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শীতের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়া মানেই প্রায় শ'খানেক স্কি-রিসোর্ট ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তার মানে, আপনারা অনুমান করতে পারেন, অজস্র চাকরি আর অজস্র টাকা।

তবে সবাই জনাব ভোল্ট্রনের মতো নৈরাশ্যবাদী নন। মাউন্টেনহোয়াইট কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তা গুয়োর হোলহৌজেনের কথাই ধরুন না কেন! নতুন ধরনের তুষারপণ্য বাজারে ছেড়েছেন তাঁরা। লোকে ডাকে তপ্ত তুষার বলে (কারণ, ওই তুষার তৈরি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রায়)। জনাব হোলহৌজেনের কথা আমি নাহয় পড়েই শোনাই-‘জলবায়ুর পরিবর্তন আল্পস পর্বতমালার জন্য বিরাট এক মওকা নিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতায় আবহাওয়া চরম গরম হওয়া এবং সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ায় সৈকতবর্তী পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা এখন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বেড়াতে যায়, দশ বছর পর তারা তুলনামূলক শীতল আল্পস অঞ্চলে আসতে থাকবে স্কি করে ছুটি কাটাবার জন্য। আমাদের দায়িত্ব হলো, বলা দরকার কর্তব্য হলো, সর্বোচ্চ মানের তুষারের জোগান নিশ্চিত করা। মাউন্টেনহোয়াইট আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে ঘন ছড়ানো-ছিটানো তুষারের। আমাদের তুষার এতই ভালো যে, স্কি-খেলোয়াড়রাও স্বীকার করবেন, এটা প্রাকৃতিক তুষারের চেয়েও খাসা।' উদ্ধৃতি শেষ।

বেশির ভাগ কৃত্রিম তুষারের মতোই মাউন্টেনহোয়াইট তুষার তৈরি হয় সিউডোমোনাস সিরিঙ্গে নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়ার ঝিল্লির ভেতরের প্রোটিন থেকে। মাউন্টেনহোয়াইটের প্রয়োজনীয় পানি নেওয়া হয় জনগণের পানীয় জলের সরবরাহব্যবস্থা থেকে। আর এ থেকে রোগবালাই না ছড়ানোর নিশ্চয়তাও তারা দিয়ে থাকে। অন্যান্য তুষার থেকে এটা এখানেই আলাদা। ‘আপনারা আমাদের তুষার বোতলে ভরে খেতেও পারেন!' গুয়েন্থার হোলহৌজেন একবার গর্ব করে বলেছিলেন। (শব্দতরঙ্গে একটানা ক্রুদ্ধদ্ধ গুঞ্জন শোনা গেল) আমি বুঝতে পারছি...কিন্তু আপনারা শান্ত হন। রাগ আপনাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দেবে এবং ভোঁতা করে দেবে সব লক্ষ্য ।

কৃত্রিম তুষার বানাতে পরমাণু-বিশোধিত, পরীক্ষিত পানি প্রচণ্ড চাপে ছুড়ে দেওয়া হয় শক্তিঘন তুষার-কামানের ভেতর দিয়ে। তুষার তৈরি হয়ে গেলে মণের পর মণ মজুদ করে রাখা হয় তিমি নামক পাত্রে। তুষারতিমিগুলো থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর, উঁচুনিচু খাঁজ ও পাথর-বেরোনো প্রাকৃতিক খুঁতগুলো ছেঁটে মসৃণ করা পর্বতের ঢালে তা ছিটানো হয়। মাটির ওপর ঘন করে ছিটানো হয় সার, যাতে তা ঠান্ডা থাকে এবং শুষে নিতে পারে তপ্ত তুষারের তাপ। এখন বেশির ভাগ স্কি-কেন্দ্র কৃত্রিম তুষার ব্যবহার করে। প্রতিটি কেন্দ্রেই রয়েছে একটি কামান। প্রতিটি কামানই বিখ্যাত ব্র্যান্ডের। প্রতিটি ব্র্যান্ডই যুদ্ধে লিপ্ত। আর প্রতিটি যুদ্ধই নিয়ে আসে নতুন মওকা।

আপনারা যদি আসল তুষারে স্কি করতে চান বা চান সত্যিকারের তুষারের দেখা পেতে, তাহলে আরও দূর যেতে হবে। যেতে হবে সেইসব রাংতা মোড়ানো হিমবাহ পর্যন্ত-বিরাট বিরাট রাংতায় ওগুলো মুড়ে রাখা হয়েছে যাতে গ্রীষ্মের তাপে বরফ না গলে, যাতে কুঁচকে না যায়। আমি জানি না, একটা আস্ত হিমবাহ রাংতায় মুড়ে রাখা কতটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আপনার মনে হবে যেন কোনো বাসি স্যান্ডউইচের ওপর দিয়ে স্কি করছেন। তার পরও চেষ্টা করে দেখতে পারেন। জানি না কেমন লাগবে ব্যাপারটা, আমি তো আর স্কি করি না। এই রাংতাযুদ্ধ হলো উচ্চতায় ঘটা যুদ্ধ, আপনাদের অনেকেরই এই প্রশিক্ষণ নেওয়া নেই (চু চু)। ভিন্ন হলেও তুষারযুদ্ধের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।

তুষারযুদ্ধের বেলায় মাউন্টেনহোয়াইটের একমাত্র আসল প্রতিপক্ষ হলো সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কল। এটা হলো পিটার হোলহৌজেনের নতুন পণ্য। আপনারা কিছু মনে না করলে সামান্য গপশপ করে নিতে চাই। এই পিটার হোলহৌজেন হলেন গুয়েন্থার হোলজহাউজেনের ভাই। আসল ভাই। তাদের বউগুলো আবার পরস্পর বোন। (গুঞ্জন) কীভাবে হলো? আচ্ছা...আসল ভাইয়েরা বিয়ে করল আসল বোনদের। দুটি পরিবারই এসেছে সালজবার্গ থেকে

মাউন্টেনহোয়াইটের থেকে সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কলের একটি বাড়তি গুণ আছে। সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কল দেয় চকমকে সুগন্ধযুক্ত তুষারের নিশ্চয়তা। অবশ্য একই দামে। সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কল পাওয়া যায় তিন রকম ঘ্রাণে-ভ্যানিলা, পাইন ও এভারগ্রিন। পর্যটকদের মনে সেই সাবেকি সময়ের ছুটির দিনের আমেজের জন্য কাতরতা জাগিয়ে তোলে এই তুষার সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কল এমন এক বুটিক পণ্য, বাজারকে তা মাতিয়ে তুলবেই, কিংবা পণ্ডিতেরা তো এমনটাই বলছেন। কেননা এই পণ্যটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এর এক চোখ ভবিষ্যতের দিকে তাকানো। সুগন্ধি তুষার ডেকে নিয়ে আসবে বৃক্ষ ও অরণ্যরাজির এক বৈশ্বিক অভিবাসন। আর পর্যটন ব্যবসার আগ্রহটা সেদিকেই। (ফিসফাস শোনা যায়) হ্যাঁ। আমি ঠিকই বলছি: বৃক্ষ-অভিবাসনের কথাই আমি বলেছি।

আপনাদের কেউ কি স্কুলে ম্যাকবেথ পড়েছেন? বেনা ঘাসের ডাইনিরা কী বলেছিল ম্যাকবেথকে, মনে আছে? বলেছিল, ‘ম্যাকবেথ তুমি অজেয়, যতদিন না পাহাড়ি বৃক্ষেরা তোমার বিরুদ্ধে যাত্রা করে?

আপনাদের মনে আছে, ‘ম্যাকবেথ জবাবে কী বলেছিল?'

(পেছনের শ্রোতাদের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘তা কখনোই হবার নয়, কে অরণ্যকে প্রভাবিত করে মাটি কামড়ে থাকা শেকড়গুলোকে উপড়াবে?')

হাহ! দারুণ! কিন্তু ম্যাকবেথ মারাত্মক ভুল করেছিল। বৃক্ষেরা ঠিকই মাটি কামড়ে থাকা শেকড়গুলোকে উপড়ে নিয়ে চলতে শুরু করেছিল। আরও ভালো জীবনের আশায় তারা তাদের বিপর্যস্ত বসতি থেকে অভিবাসী হয়েছিল। মানুষের মতোই। মৌসুমি গাছগুলো আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে উঠে আসছে। চিরসবুজ বৃক্ষমালা একটু শীতল আবহাওয়ার খোঁজে চড়ছে গিয়ে আরও উঁচু জায়গায়। আর স্কি করার পাহাড়ি ঢালে, তপ্ত তুষারের ভারী আচ্ছাদনের নিচে, সারে ভরা উষ্ণ মাটিতে লুকানো বীজগুলোতে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে। হয়তো শিগগিরই আমরা পার্বত্য উপত্যকায় ফলফলাদির গাছ, আঙ্গুরের বাগান এবং জলপাইয়ের সারি দেখতে পাব।

এভাবে গাছেদের অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে পাখি, পোকামাকড়, মৌমাছির দল, বাদুড় এবং পরাগায়ণ ঘটায় এমন সব পতঙ্গও দলবেঁধে চলে আসছে। নতুন পরিপার্শ্বের সঙ্গে তারা কি মানিয়ে নিতে পারবে? চড়ুই পাখিগুলো এর মধ্যে আলাস্কায় পৌঁছে গেছে। আলাস্কার বলগা হরিণেরা মশাবাহিত মড়কের শিকার হয়ে আরও উঁচু ভূমিতে পালাচ্ছে। সেখানে তারা পাবে অফুরান খাদ্য। আর মশাবাহিত ম্যালেরিয়া দিয়ে ভরে যাচ্ছে আল্পসের নিচু অঞ্চল।

আমি ভেবে ধন্ধে পড়ি, ভারী গোলাবর্ষণের মুখে অজেয় করে বানানো এ দুর্গ মশাদের আক্রমণের মুখে কী প্রতিরোধ তৈরি করবে?

তুষারযুদ্ধ সমতলেও ছড়িয়ে পড়ছে। মাউন্টেনহোয়াইট এখন সৌদি আরব ও দুবাইয়ের বাজারেও দাপট দেখাচ্ছে। চীন ও ভারতেও তদ্বির চলছে জায়গা করে নেওয়ার জন্য। কিছু সাফল্যের মুখও তা দেখেছে। বাঁধ তৈরির প্রকল্পগুলো তুষার- কামানের কাছে নিবেদিত হয়েছে। নিবেদিত হয়েছে সব মৌসুমের উপযোগী স্কি- কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য। বাঁধ শক্তিশালী করার উসিলায় ওরা ডাচদের দেশেও ঢুকে পড়েছে। পাশাপাশি তারা সমুদ্রে ভেলার ভিতের ওপর বাড়িও বানাচ্ছে। যখন সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে উঠবে আর বাঁধগুলো যাবে ভেঙে, তখনো হল্যান্ড সমুদ্রে ভাসতে থাকবে। মাউন্টেনহোয়াইট সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউকে আরও জোরদার করে বদলে ফেলবে সোনায়। অর্থাৎ ব্যবসায়। 'ভয় নেই, মাউন্টেনহোয়াইট হাজির' সেগান সমভূমির মতো ওখানেও সমান কার্যকর। এসব দেখে সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কলও বহুমুখী হয়েছে। তারা একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের মালিকানা নিয়ে নিয়েছে এবং এক অকার্যকর-ভূমি মাইন উৎপাদক কোম্পানির শেয়ারের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। সম্ভবত, তাদের নতুন পণ্যের তালিকায় যোগ হতে যাচ্ছে সুগন্ধি-স্ট্রবেরি, ক্রেনবেরি, জজবা। এগুলো একই সঙ্গে পশু-পাখি ও শিশুদের টানবে। তুষার ও ভূমিমাইন ছাড়াও সেন্ট অ্যান্ড স্পার্কল ব্যাটারিচালিত কৃত্রিম হাত-পা ছেড়ে বাজার সয়লাব করে দিয়েছে। বিশেষত আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মানুষদের মাপের সঙ্গে মানানসই করে এগুলো বাজারে ছাড়া হয়েছে। এই কোম্পানিটি আবার করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আন্দোলনের প্রধান সৈনিক। একই সঙ্গে আফগানিস্তানে এরা খুবই চমৎকার এক গুচ্ছ এতিমখানা ও এনজিও চালায়। আমি জানি আপনারা অনেকেই এসবের সঙ্গে পরিচিত আছেন। সম্প্রতি কোম্পানিটি কৃত্রিম তুষার ও রাসায়নিক সারের অবশেষ মিশে সম্পূর্ণ বিষিয়ে যাওয়া ইতালি ও অস্ট্রিয়ার নদী ও হ্রদ খননের জন্য দরপত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এমনকি এখানে, দুনিয়ার একেবারে শীর্ষেও ওইসব রাসায়নিক অবশেষ আর অতীতের বিষয় নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। মাত্র আমরা কিছু মানুষ অন্য মানুষদের লালসার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ইঁদুরের মতো করে বাঁচতে শিখেছি। আমরা শিখেছি হাওয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র বানিয়ে সজ্জিত হতে। আমরা জানি কি ভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। এটাই তো আমাদের রপ্ত করা যুদ্ধকুশলতা।

কমরেডগণ, পর্বতের শিখরে বসে থাকা পাথরের সিংহ দুর্বল হতে শুরু করেছে। যে দুর্গটি কখনোই আক্রান্ত হয়নি, তা এখন নিজের হাতেই দখল হয়ে গেছে। এখনই সময় আমাদের কাজ শুরু করার। বিশৃঙ্খল এলোমেলো ও লক্ষ্যহীনভাবে মেশিনগান ছোটানোর বদলে এখন সময় এসেছে ঠান্ডা মাথায় আততায়ীর বুলেটের মতো নির্ভুল নিশানা করার। হুঁশিয়ার হয়ে যাঁর যাঁর নিশানা ঠিক করে নিন।

আমার আর কিছু বলবার নেই। এখন আপনারা ছড়িয়ে যেতে পারেন। নির্দেশনাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নিন। সব ভালোভাবে চলুক, কমরেডগণ, কোনো চিহ্ন রেখে যাবেন না। আবার মিলিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ঈশ্বর আপনাদের যাত্রা শুভ করুন, খোদা হাফেজ এবং আপনাদের গানপাউডার যাতে না ভেজে।

(অনেকগুলো পায়ের চলে যাওয়ার শব্দ। আস্তে আস্তে নীরব হয়ে এল সবদিক)

অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ


Post a Comment

0 Comments