Ticker

6/recent/ticker-posts

যাঁরা থাকেন মণিকোঠায় - মীনাক্ষী দত্ত

 যাঁরা থাকেন মণিকোঠায়

রংবাজ

মীনাক্ষী দত্ত

রিটনের বইয়ের হাট

শুনেছো কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো?

আকাশের গায়ে নাকি থাক থাক গ্ৰন্থ !

আপনি কি একজন গ্রন্থানুরাগী? প্রিয় বই লাইব্রেরিতে খুঁজে খুঁজে হদ্দ, পুরনো বইয়ের দোকান ঘুরে ঘুরে হয়রান? আঠারো, উনিশ শতক তো বাদই দিচ্ছি, অতি সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বইও থাকে আউট অফ প্রিন্ট। যে বই যখন জনপ্রিয় সে বই ছাড়া দোকানে সাহিত্যসম্ভার বলতে গেলে আর কিছু মেলে না। গড়িয়াহাটে দুটি-তিনটি বইয়ের দোকান আছে বটে, কিন্তু সেখানে টেক্সট বইয়ের বাইরে আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' চাইবার ধৃষ্টতা আমার একবার হয়েছিল, তাতে দোকানি আকাশ থেকে পড়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, “ও-সব বইয়ের কাটতি নেই”।


গড়িয়াহাট না হয় প্রান্তিক, কলেজ স্ট্রিটে, এমন-কি ক্ল্যাসিকসও অনায়াসে পাওয়া যায় এমন নয়। যে নামই করা যায়, নেই ।

হতাশ হবেন না। এখন সবই পাওয়া যাচ্ছে vertual reality-তে। বাংলা সাহিত্যে এ যাবৎ যত বই লেখা হয়েছে, তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে ‘ইন্টারনেটে বইয়ের হাটে'(www.boierhat.com/fb)।

আটলান্টাবাসী আইটি বিশেষজ্ঞ রিটন খান ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাইটেল সংগ্রহ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের কত বই-ই না হারিয়ে যাচ্ছিল, তিনি একটু একটু করে সংগ্রহ করে মহাকাশে তৈরি করেছেন অক্ষয় গ্রন্থাগার। ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, বাংলা অ্যাকাডেমি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ইত্যাদি ছাড়াও ব্যক্তিগত সংগ্রহ, উঠে যাওয়া লাইব্রেরি, নিলাম, পুরনো বইয়ের দোকান— সব জায়গা থেকে বই স্ক্যান করে তুলে রাখছেন ‘বইয়ের হাটে'র সংগ্রহে। ‘বইয়ের হাটে'র সদস্যরা এই ওয়েবসাইটে কোনও লেখক ও বইয়ের নাম দিলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বইটি ডাউনলোড করতে পারবেন। বিস্ময়ের কিছু নেই যে এরকম একটা ইন্টারনেট গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা ইতিমধ্যেই লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। হেলসিংকি থেকে টরন্টো বইয়ের হাটের সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন। বলা যায়, এটা একটা বিশাল গ্রন্থতত্ত্ব সরবরাহ জাল। কোনও প্রশ্নের মাছি পড়লেই পুরো জাল নেচে ওঠে।

রিটনের জন্ম খুলনায় ১৯৭৯ সালে। মামা নিয়ে যেতেন বৈশাখী মেলায়, ঝুড়ি ভরে খেলনা কিনে দিতেন। একটু বড় হতে একবার কিনে দিলেন বই, মেলায় যা বিক্রি হচ্ছিল তাই— ঠাকুমার ঝুলি, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, সোবিয়েত রাশিয়া প্রকাশিত নানান অনুবাদ। পাঠ্যবই নয়, শুধুমাত্র উপভোগের জন্য বই পড়া সেই প্রথম।

বইয়ের জগৎ আবিষ্কারে সাহায্য করলেন আবদুল্লা আবু সয়ীদ। তিনি একজন টিভি পার্সোনালিটি— উপস্থাপনা ও হাস্যরসের জন্য বাংলাদেশে বিখ্যাত। ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে'র প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে তাঁর কেন্দ্র পৌঁছে দেয় বই। তাঁর চলমান গ্রন্থাগার আন্দোলনের জন্য পেয়েছেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার। রিটনের স্কুলেও যেত কেন্দ্রের গাড়ি। প্রতি সপ্তাহে বই পেত। এ ছাড়া রিটন সুযোগ নিয়েছিল খুলনার উমেশচন্দ্র লাইব্রেরির। টাকা পেলে বইও কিনত, অথবা বইয়ের দোকানে গিয়ে কোনায় দাঁড়িয়ে বই পড়ত। দোকানের মালিক অনেক সময় বলতেন, বাড়ি নিয়ে গিয়ে পড়ো, সাবধানে পড়বে, যেমনটি নিয়ে যাচ্ছ, ঠিক তেমনটি ফেরত দেবে।

তার পড়া প্রথম কবিতার বই রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লার। রিটন বলে, ‘এইসব বই পড়েই ক্লাস নাইন থেকে আমার ধারণা পাল্টে যায় ধর্ম বিষয়ে। বুঝতে পারি যে আল্লা, গড বা ভগবান বলে কিছু নেই।' প্রতিষ্ঠিত ধর্মের প্রতি জন্মাল সংশয়। সংস্কারের স্থান নিল অনুসন্ধিৎসা।

ওর এক চাচা লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজ করতেন। তিনি কাগজপত্র বানিয়ে তাদের আমেরিকায় ইমিগ্রেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে সে মা-বাবা- বোনের সঙ্গে চলে আসে আমেরিকায়।

১৯৯৬ সালের আগস্টের এক ভোররাত্রে তারা নিউ ইয়র্কের জে এফ কে এয়ারপোর্টে নেমেছিল। চাচা তাঁর বন্ধু সায়রা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের থাকার সাময়িক ব্যবস্থা করেছিলেন।

কুইন্সের সানিসাইডে থাকতেন সায়রা বেগম তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তাঁর ছেলে মানু এয়ারপোর্টে পৌঁছে তাদের নিয়ে গেল নিজেদের বাড়িতে। গাড়িতে উঠেই মানু চালিয়ে দিয়েছিল বাংলা গানের সিডি— অঞ্জন দত্তর গান। খুব ভাল লেগেছিল রিটনের, মনে হয়েছিল, “বাঃ!”

সেদিনই বিকেলে মানুভাই তাকে নিয়ে গেল কুইন্সের যাকে বলা হয় ‘লিট্ল ইন্ডিয়া' সেই জ্যাকসন হাইটসে। ৭৪ স্ট্রিটে ফুটপাত থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে বেসমেন্টে, সিঁড়িতে পা রেখেই চোখে পড়ল সাইনবোর্ড, বাংলায় লেখা ‘অনন্যা’— বাংলা বইয়ের দোকান।

দেশে ওর কিছু বই জমেছিল, ফেলে আসতে হয়েছে। এখানে চার দেওয়ালে বই, যা ফেলে এসেছে তার বদলে এক নতুন সম্ভার। একপাশে টেবিলে বসে এক ছিপছিপে উজ্জ্বল যুবক । আরও দুজন তাঁর সামনে। পরে জেনেছিল ওই দুজনের একজন সালিমউল্লা খান, তখন নিউ ইয়র্কএ পিএইচডি করছেন। আর অন্যজন আবেদিন কাদের – বাংলা সাহিত্যের খুঁটিনাটি তিনি যা জানেন তা দিয়ে দু-চারটি পিএইচডি আপনাসে হয়ে যায়। ‘অনন্যা’র মালিক সৈয়দ শহীদ নিজেই অনন্য, একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, দুই বাংলার প্রকৃত সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। বাংলা বই, সিনেমার ক্যাসেট, গান— সারা নিউ ইয়র্কে ‘অনন্যা’তে শুধু পাওয়া যায় তখন। (পরে অবশ্য হয়েছে ‘মুক্তধারা’, বিশ্বজিৎ সাহার দোকান। শহীদের যে বিক্রিতে তেমন উৎসাহ আছে এমনটা মনে হয়নি রিটনের। একজন ক্রেতা এসে একটি বাংলা সিনেমার ক্যাসেট চাইলেন, শহীদ বলল, ‘আছে ওটা, তবে কিনবেন না। একদম বাজে ছবি।”

রিটন মনে করে তার প্রকৃত শিক্ষক শহীদ । এতদিন সে যা পেত পড়ত, শহীদ তার রুচিতে শান দিল। ফাঁক পেলেই সে ‘অনন্যা'য় চলে যেত।

শহীদ বলত, ‘কিনতে হবে না, দোকানে বসে পড়'। বলে দিত কী বই পড়তে হবে। তখন সবে কম্পিউটার এসেছে। মানুভাই একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনল, যা ব্যবহার করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিল রিটনকে। লেদার গুডসের দোকানে চাকরির ফাঁকে ফাঁকে চলল বাংলা বই পড়া আর কম্পিউটার চালানো। আমেরিকা আসার প্রথম সপ্তাহেই এরা দুই জন তার হাতে তুলে দিয়েছিল বই ও কম্পিউটার— দুই দরজার চাবি।

যে কাজ পেয়েছে তাই নির্দ্বিধায় করেছে রিটন, অ থেকে অনুস্বার পর্যন্ত। এই করে সে কমিউনিটি কলেজ থেকে বি এ পাস করে রিচার্ড স্টকটন ইউনিভার্সিটি থেকে আই, টি ডিগ্রি করল। এখন সে কাজ করে হেলথ ক্যাটালিস্ট নামের কোম্পানিতে সফ্টওয়্যার প্রোগামিঙে, তার এবং তার টিমের উদ্ভাবিত এক সফ্টওয়্যার বিশেষ ভাবে ক্লিক করেছে। ৩০০,০০০ প্রোভাইডার সেটা ব্যবহার করে। স্ত্রী লাবণি ও দশ বছরের ছেলে তাহানকে নিয়ে তাদের সংসার। হিউ এন সাঙকে হিমালয় ডিঙোতে হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সন্ধানে। আর আজ আলোকরশ্মির গতিতে স্ক্যান করা বইয়ের লাখ লাখ কিলোবাইট তথ্য আপলোড ডাউনলোড হয়ে যায়। বাংলা বইয়ের জগতে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা যে হিতসাধন করেছিলেন, বলা যায় এটা তার পরবর্তী ধাপ। কেরি সাহেবের মতই একদিন হয়ত স্মরণীয় হবে রিটন খানের নাম।

Post a Comment

0 Comments