Ticker

6/recent/ticker-posts

স্বরাজের পথে - হিতেশরঞ্জন সান্যাল


 

স্বরাজের পথে

হিতেশরঞ্জন সান্যাল


ভূমিকা

১৯৭৩ সালে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস-এ যোগ দেওয়ার পর থেকে হিতেশরঞ্জন সান্যাল দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ততদিনে তিনি তাঁর পি-এইচ. ডি গবেষণার কাজ শেষ করেছেন। বিষয় ছিল পশ্চিম বাংলায় মন্দির নির্মাণের সামাজিক ইতিহাস। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন আঠারো-উনিশ শতকে দক্ষিণবঙ্গ ও রাঢ় অঞ্চলের সামাজিক স্তরবিন্যাসে উত্থানপতনের বিচিত্র কাহিনী। আর সেই সঙ্গে পরিচয় ঘটে যায় ঐ অঞ্চলের শত শত গ্রাম, গঞ্জ, হাট, বাজার, পথ আর মানুষজনের সঙ্গে। তখন থেকেই ভেবেছিলেন, অনুসন্ধান শুরু করবেন এই সব জায়গার আরো সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিষয়ে, যেখানে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন আর সামাজিক সংঘাতের জটিল প্রক্রিয়া।

হিতেশবাবু তাঁর গবেষণা-পদ্ধতিকে খুব সচেতনভাবেই প্রসারিত করেছিলেন মহাফেজখানার দস্তাবেজের বাণ্ডিল ছাড়িয়ে অনেক দূরে। মন্দির নিয়ে কাজ করার সময় যেমন তিনি চলে যেতেন বহু দুর্গম জায়গায়, বাস-রাস্তা জনবসতি পেছনে ফেলে, বনবাদাড় পেরিয়ে কোনো ভাঙা মন্দিরের সন্ধানে। যেখানে পৌঁছে ফিতে নিয়ে মাপজোক করতে লেগে যেতেন, ছবি তুলতেন ক্যামেরায়। ঠিক সেইরকম রাজনৈতিক আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে হিতেশবাবু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘুরে বেড়িয়েছিলেন মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-বীরভূম-পুরুলিয়া-বর্ধমান-হাওড়া-হুগলীর গ্রামে গ্রামে। কথা বলেছিলেন অন্তত কয়েক হাজার রাজনৈতিক কর্মী, নেতা, রাজকর্মচারী অথবা প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে। সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয় পত্রিকা, বুলেটিন, লিফলেট, সভাসমিতির কার্যবিবরণী কিংবা অর্ধশতাব্দী আগেকার কোনো গ্রামবাসী ডায়েরি-লেখকের দিনলিপি। এ-কাজে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন বাংলার লোকসংস্কৃতি-বিশেষজ্ঞ আর-এক উৎসাহী গবেষক শ্রীতারাপদ সাঁতরা।

দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে হিতেশবাবুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৯৭৪ থেকে। পরবর্তী পনেরো বছরে বাঙলা-ইংরেজি মিলিয়ে এই বিষয়ে ওঁর গবেষণা-প্রবন্ধের সংখ্যা অন্তত কুড়ি। যত ব্যাপকভাবে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তার সব বিষয় বা অঞ্চল নিয়ে লিখে যেতে পারেননি। যেমন মানভূমের আন্দোলন সম্বন্ধে বিশাল পরিমাণ মালমশলা রয়ে গেছে তাঁর সংগ্রহে, কিন্তু ঐ বিষয়ে কোনো প্রবন্ধ লেখার সুযোগ তাঁর ঘটেনি।

জাতীয় আন্দোলন নিয়ে প্রবন্ধ লেখার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দিন তিনি আরো একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে শুরু করেন। সেটি হল বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার। এই বিষয়ে একাধিক অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ ছাড়া একটি বইও লেখেন তিনি—‘বাংলা কীর্তনের ইতিহাস’—যেটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিষয়ে একটি পুরোদস্তুর গবেষণাগ্রন্থ লেখার ইচ্ছা তাঁর বরাবরই ছিল। অনেকগুলি দীর্ঘ প্রবন্ধেই এরকম একটি কাজের প্রস্তুতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৮৮-তে তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুতে সেই সম্ভাবনার অবসান ঘটল।

বর্তমান প্রবন্ধ-সংকলনটি এই অভাব অন্তত কিছুটা পূরণ করতে পারে। দক্ষিণ- পশ্চিম বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে হিতেশবাবুর কাজের পরিসর, তথ্যের অভিনবত্ব ও প্রাচুর্য, এবং বিশ্লেষণের মৌলিকতা এই প্রবন্ধগুলিতে অনেকটাই প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত লেখাগুলি একত্র করে সাজানোর পর দেখা গেল, বিষয় এবং বিশ্লেষণ উভয় দিক দিয়েই সংকলনটি বেশ খানিকটা সামগ্রিকতা অর্জন করেছে। এই সামগ্রিকতার খাতিরেই স্থির হয়, মেদিনীপুরে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন নিয়ে হিতেশবাবুর একটি ইংরেজি প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করে এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তাঁর কোনো বাঙলা প্রবন্ধ ছিল না। প্রবন্ধ নির্বাচন এবং সম্পাদনার ক্ষেত্রেও প্রধানত এই কথাটাই মনে রাখা হয়েছে—বিষয়টি নিয়ে হিতেশবাবুর গবেষণার ব্যাপ্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্বতা একটি গ্রন্থের পরিসরে যাতে যথাসম্ভব তুলে ধরা যায়।

জাতীয়তাবাদ এবং গ্রামাঞ্চলের গণ-আন্দোলন সম্পর্কে হিতেশবাবুর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই বিশিষ্ট। ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক ইতিহাস-লেখকদের মধ্যে ইতিহাস-রচনার যে বিভিন্ন ধারা-উপধারা এখন প্রচলিত আছে তার কোনোটির সঙ্গেই তাঁর লেখা পুরোপুরি খাপ খায় না। তাই, শুধুমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ বলেই নয়, দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিকতা এবং তার বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গির জন্যও হিতেশবাবুর এই লেখাগুলির গুরুত্ব বহুদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে।

লেখার প্রকরণগত দিক এবং বিশেষ করে রচনাশৈলী সম্বন্ধে হিতেশবাবু প্রখরভাবে সচেতন ছিলেন। বিভিন্ন লেখায় নিজের রচনাশৈলী নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষাও করতেন তিনি। এখানে যেমন কোনো কোনো প্রবন্ধে তিনি সাধু বাঙলা ব্যবহার করেছেন, আবার কোনো কোনো প্রবন্ধে চলিত। গ্রন্থ সম্পাদনার চালু প্রথা কিছুটা অমান্য করেই আমরা একই বই-এ এই দু-রকম ভাষা বহাল রেখেছি, হিতেশবাবুর নিজস্ব স্টাইলকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত হবে না, এই মনে করে। শুধু একাধিক প্রবন্ধে একই প্রসঙ্গের পুনরুক্তি ঘটে থাকলে তবেই অনাবশ্যক অংশগুলিকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

এই সংকলনটি প্রস্তুত করার কাজে আমার সঙ্গে সমানভাবে অংশ নিয়েছেন গৌতম ভদ্র, দেবেশ রায় ও মনস্বিতা সান্যাল।

তথ্য সংগ্রহের কাজে হিতেশবাবু যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন, তার অধিকাংশ সময়েই আমি হতাম তাঁর সহযাত্রী। এই প্রবন্ধগুলি লেখার সময়ও প্রায় দৈনিক আলোচনা ও বিতর্কের অংশীদার ছিলাম আমি। অসম্পূর্ণ আকারে হলেও, তাঁর এই গবেষণার ফলাফলগুলি যে একত্রিত করে ইতিহাস-পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া যাচ্ছে, তাতে হিতেশবাবুর সহকর্মী, বন্ধু ও অনুরাগী আমরা বিশেষভাবেই আনন্দিত।

কলকাতা

১৫ অগাস্ট ১৯৯৩

পার্থ চট্টোপাধ্যায়


সূচি

স্বরাজ

অহিংসা

অভয়

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-পর্বে বাংলার প্রাদেশিক রাজনীতি

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : পূর্ব মেদিনীপুর

মেদিনীপুর জিলায় ‘ভারত ছাড়ো' আন্দোলন

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : আরামবাগ

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : বাঁকুড়া জেলা

স্বাধীনতা সংগ্রামে স্থানিক মাত্রা

জনগণ, কংগ্রেস ও গান্ধীজী


Post a Comment

0 Comments