Ticker

6/recent/ticker-posts

স্বরাজ রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ধারণা

 স্বরাজ

রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ধারণা

হিতেশরঞ্জন সান্যাল

‘স্বরাজ' শব্দটি অত্যন্ত পুরাতন। সায়ণাচার্যের টীকা অনুসারে ঋগ্বেদে স্বরাজ শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে ‘স্বয়ং রাজমান' অর্থে। আধুনিক ধারণায় স্বরাজ বলিতে বুঝায় স্বদেশী শাসনকর্তৃত্ব। স্বরাজ কথাটির এই অর্থ আমাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তার মধ্যে গড়িয়া উঠিয়াছে। তবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বরাজ কথাটির ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য সৃষ্টি হইয়াছে। আধুনিক রাজনৈতিক অর্থে স্বরাজ কথাটির ব্যবহার সম্ভবত বালগঙ্গাধর তিলক গত শতাব্দীর শেষ দিকে আরম্ভ করেন। তিলক স্বরাজ বলিতে বুঝাইয়াছিলেন ভারতশাসনে ভারতীয়দের সার্বভৌম অধিকার। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম স্বরাজের এই তাৎপর্য অবলম্বন করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল। ইংরেজের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল সার্বভৌমিকতা অর্জন। প্রথম বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১৯১১ ) বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজকর্মে ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের রচনায় সার্বভৌমিকতা অর্থে স্বরাজের তাৎপর্য স্পষ্ট, আরও প্রসারিত হয়। বিদেশী শাসন, পণ্য, শিক্ষা ও ধ্যানধারণার পরিবর্তে স্বদেশী চালাইবার যে চেষ্টা এই সময় হইয়াছিল তাহার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে ভারতীয় সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠা। বিংশ শতকের প্রথম দিকে সর্বভারতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিলেন লালা লাজপৎ রায়, বালগঙ্গাধর তিলক এবং বিপিনচন্দ্র পাল। ভারতের বিভিন্ন অংশে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীগণও সার্বভৌম অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করিয়াছিলেন। তবে তাঁহারা স্বরাজ বলিতে প্রধানত রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতা বুঝিতেন।

স্বরাজের আর একটি তাৎপর্য উদারনৈতিক, নরমপন্থী জাতীয়তাবাদীগণের চিন্তা ও কার্যকলাপ হইতে উদ্ভূত হয়। নরমপন্থীগণের ভাষ্য অনুসারে স্বরাজ বলিতে বুঝায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারতীয় স্বায়ত্তশাসন। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে স্বায়ত্তশাসন বলিতে বুঝাইত দেশের শাসনব্যবস্থায় অর্থাৎ নীতিনির্ধারণ এবং কার্যপরিচালনায় ভারতীয়গণের অংশগ্রহণ করিবার অধিকার। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্বায়ত্তশাসন কথাটির তাৎপর্য ক্রমশ প্রসারিত হইতে থাকে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেস সভাপতিরূপে দাদাভাই নওরোজী স্বরাজ বলিতে আইন প্রণয়ন এবং আর্থিক ব্যবস্থা ও আভ্যন্তরিক শাসন পরিচালনায় ভারতীয়গণের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবী করিয়াছিলেন। দুই বৎসর পরে, ১৯০৮ সালে, জাতীয় কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে বলা হয় যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত স্বশাসিত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সমানাধিকার অর্থাৎ সাম্রাজ্যের যৌথ অংশীদার হইবার অধিকার অর্জন করাই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য। এখানে বক্তব্য খুব স্পষ্ট নয়। কারণ ব্রিটিশের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যৌথ অংশীদার ভারতীয়গণ কি ভাবে হইতে পারে তাহার কোনো ব্যাখ্যা জাতীয় কংগ্রেস দেয় নাই। আবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত অপরাপর স্বয়ংশাসিত দেশ, যেমন ক্যানাডা বা নিউজিল্যাণ্ডের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক কি সে বিষয়ে সাংবিধানিক সংজ্ঞা তখনও নির্ধারিত হয় নাই। তবে ১৯০৮ সালের কংগ্রেস গঠনতন্ত্র পড়িলে বুঝা যায় স্বায়ত্তশাসন বলিতে আগের তুলনায় আরও খানিকটা বেশি অধিকারের কথা বলা হইতেছে। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও ( ১৯২১-২২ ) কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে আভ্যন্তরিক বিষয়সমূহে অর্থাৎ আইনগত, আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জন করা। চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের মধ্যে গঠিত স্বরাজ্য পার্টি ( ১৯২২ ) শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং শাসন বিভাগের উপর জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি মণ্ডলীর সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবী করে। ফলে স্বায়ত্তশাসন অর্থে স্বরাজের তাৎপর্য আরও প্রসারিত হয়। ইহার কিছু দিন আগে মন্টেগু- চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার ( ১৯১৯ ) অনুসারে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় সীমিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি লইবার এবং বেসরকারী সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাখিবার ব্যবস্থা করা হয়। ইহা ছাড়া প্রদেশসমূহে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের মধ্য হইতে কয়েকজন মন্ত্রী নিয়োগ ও কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদে কয়েকজন ভারতীয় নিয়োগের ব্যবস্থাও ছিল। ব্রিটিশরা এই শাসনসংস্কারকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারতীয় স্বরাজের সূচনা বলিয়া অভিহিত করিয়াছিল।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবী করিয়া জাতীয় কংগ্রেস স্বরাজের যে ব্যাখ্যা দিত তাহাতে কংগ্রেসের মধ্যে অনেকেই সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই। ইঁহারা চাহিতেন কংগ্রেস সর্বপ্রকার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটাইয়া সার্বভৌমিকতা অর্জনের জন্য আন্দোলন করুক। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের স্বাতন্ত্র্য ও ব্যাপকতা বুঝাইবার জন্য ইঁহারা ‘পূর্ণ স্বরাজ' কথাটি ব্যবহার করিতেন। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে ইঁহারা পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপন করেন। কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে স্বরাজের উভয় ব্যাখ্যা প্রচলিত ছিল। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীগণ সার্বভৌমিকতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের চেষ্টা করিতেছিলেন। মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় কমিটি প্রণীত ভারতের খসড়া শাসনতন্ত্রে ( ১৯২৮ ) এই দুইটি মতের সামঞ্জস্য করিয়া স্বরাজের আর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। নেহরু কমিটি ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন মর্যাদা সুপারিশ করে। ডোমিনিয়ন মর্যাদা পাইলে আভ্যন্তরিক ও বহির্বিষয়ক সকল ব্যাপারে ভারত সম্পূর্ণ স্বাধীন হইবে, তবে সার্বভৌমিকতার অধিকার ন্যস্ত থাকিবে ব্রিটিশ সম্রাটের হাতে। পরের বৎসর, ১৯২৯ সালে, সার্বভৌমিকতার দাবী কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই বৎসরে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবী গৃহীত হয়। পূর্ণ স্বরাজের দাবী জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিবার উদ্দেশ্যে ১৯৩০ সাল হইতে ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালিত হইতে থাকে। পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব গৃহীত হইবার পর হইতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব আন্দোলনের মতো কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামও পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। ভারত স্বাধীনতা লাভ করে (১৯৪৭ ) ডোমিনিয়ন হিসাবে। কারণ, স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতীয় শাসনতন্ত্র পরিষৎ স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সম্পূর্ণ করিয়া উঠিতে পারে নাই। শাসনতন্ত্র প্রচলিত হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। এই দিনে পূর্ণ স্বরাজের আদর্শ অনুসারে স্বাধীন ভারত সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

গান্ধীবাদী প্রত্যয়

গান্ধীবাদ অনুসারে ‘স্ব’ কথার অর্থ ব্যক্তি এবং স্বরাজ বলিতে বুঝায় নিজস্ব জীবনের উপর ব্যক্তির অধিকার। সমাজ চালাইবার জন্য অতীতকালে মানুষ পঞ্চায়েৎ গড়িয়াছিল। মণ্ডল বা মুখ্যা এবং মাতব্বরগণ সকলের মত নিয়া কাজ চালাইত। মণ্ডল বা মুখ্যা প্রধান বলিয়া শাসন করিবার অধিকার পাইত না। সমানে সমানে লেনদেনের জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় যে সংগঠন গড়িয়াছিল সকলের সম্মতি নিয়া সেই সংগঠনের কাজকর্ম চালাইবার দায়িত্ব মণ্ডল বা মুখ্যার উপর দেওয়া হইত। এইরূপ ব্যবস্থা কৌম গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এখনও দেখা যায়। এই ব্যবস্থার মধ্যেই কিছু উদ্যোগী লোক খানিকটা পরিমাণ উদ্বৃত্ত ধন ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র আয়ত্ত করিয়া রাষ্ট্র পত্তন করে। ইহাদের কৌশল ও অস্ত্রবলে উদ্বৃত্ত সংগ্রহের ব্যবস্থা নিয়মিত ও রীতিসম্মত হইয়া উঠিল। ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও খুব বাড়িয়া গেল এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়াইয়া পড়িতে লাগিল। ধীরে ধীরে মানুষের খাওয়া, পরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি আমোদপ্রমোদ ও ধর্মকর্মের উপরেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ জন্মিল। রাষ্ট্র বিশাল বটগাছের মতো সমাজের গভীরে ক্ষমতার শিকড় চালাইয়া দিল এবং উপরে নানা কাজের অছিলায় ঝুরি নামাইয়া সমস্ত সমাজকে আঁকড়াইয়া ধরিল। ঝুরি এত বেশি ও ঘন হইয়া নামিতে লাগিল যে গাছের নীচে আলো বাতাস ভালো করিয়া ঢুকিতে পারিল না। ফল কথা এই যে মানুষের জীবনে সব কিছুই হইল রাষ্ট্রশক্তি ও তাহার প্রতাপশালী নিয়ন্তাগণের অধীন। আধুনিক রাষ্ট্র মানুষের খাওয়া-পরা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের একটা ব্যবস্থা করিয়া দিয়া আপাত নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির পুরা নিয়ন্ত্রণ থাকে শ্রেণী, দল বা গোষ্ঠীবিশেষের উপর। প্রত্যক্ষ শাসন তো ইহারা করেই। তাহা ছাড়া যে সমস্ত জিনিস ইহারা হাতে তুলিয়া দেয় সাধারণ মানুষকে তাহা দ্বারাই প্রয়োজন মিটাইতে হয় এবং সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করিতে হয়। নিজেদের প্রয়োজনে ইহারা মানুষের ভাত-কাপড়ে টান ফেলিয়া দিতে পারে, আবার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে কোনো রকম পরিবর্তন ঘটাইতে পারে। নিজেদের অধিকার বিস্তার বা সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রনিয়ন্তাগণ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় এবং তাহার ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়া যায়। তখন জাতীয় স্বার্থ বা তত্ত্বের নামে সাধারণ মানুষও যুদ্ধে জড়াইয়া পড়ে এবং কষ্ট ভোগ করে। কিন্তু তবুও সাধারণ মানুষ যুদ্ধের সমর্থনে কথা বলে এবং কাজ করে। ফলত আধুনিক রাষ্ট্রনিয়ন্তাদের ক্ষমতা অপরিসীম। পীড়ন করিতেও তাহারা পরান্মুখ নয়। কেহ বশ না মানিলে পীড়নের দ্বারা বশ মানাইয়া লয়। পীড়ন সোজাসুজি হইতে পারে, আবার পরোক্ষভাবেও করা যায়। গান্ধীজীর মতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ভাবেই করা হোক না কেন, পীড়নমাত্রই হিংসা, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা হিংসার নামান্তর। রাষ্ট্রের মতো উগ্র ও উপদ্রবী প্রতিষ্ঠান আর নাই ।

গান্ধীজী বলিতেছেন এইরূপ হিংসাক্লিষ্ট পরিবেশে পরনির্ভরশীল ও পরমুখাপেক্ষী জীবনে মানুষের কোনো সুখ নাই। নিজের জীবনের উপর তাহার কোনো অধিকার থাকে না। ফলে, মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তিসমূহের স্বচ্ছন্দ বিকাশ ব্যাহত হয়। এইরূপ পরিস্থিতি হইতে মুক্ত হইতে হইলে রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকৃত করা অত্যাবশ্যক। জীবনধারণের জন্য মানুষ যদি রাষ্ট্র অথবা কোনো বিশেষ শ্রেণী বা সংগঠনের উপর নির্ভরশীল হয় তবে ক্ষমতা কেন্দ্ৰীভূত থাকিয়া যাইবে এবং মানুষের দুঃখও ঘুচিবে না। তাই ভাত-কাপড়ের জন্য মানুষকে স্বনির্ভর হইতে হইবে। যেটুকু সহায়সম্বল ব্যক্তি বা আর একটু বড় পর্যায়ে গ্রামের আয়ত্তাধীন তাহার মধ্যেই মোটা ভাত-কাপড় ও মোটামুটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে বেশি নজর দিলে, অর্থাৎ বাহিরের ভোগ্যপণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হইলে সমাজের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে চলিয়া যাইতে বাধ্য। সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উৎপাদন করিতে হইলে এমন সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা দরকার যেগুলি তাহারা নিজেরাই তৈয়ার ও মেরামত করিতে পারে। নিজের প্রয়োজন নিজেকে মিটাইতে হইলে সকলকেই শারীরিক পরিশ্রম করিতে হইবে। প্রত্যেকে সরাসরি অন্নবস্ত্র উৎপাদন না করিলেও নিজের খাদ্য ও বস্ত্র উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনে সমপরিমাণ শারীরিক শ্রম তাহাকে করিতে হইবে। শুধুমাত্র বুদ্ধি বেচিয়া কেহ খাইতে পারিবে না, বা উন্নততর কৌশল প্রয়োগ করিয়া কেহ অপরের উপর প্রভাব খাটাইতে পারিবে না। জীবনধারণের প্রয়োজনে ভারী ও সূক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহার করিলে মানুষের স্বাবলম্বন নষ্ট হইবে। কারণ ঐরূপ যন্ত্রপাতি তৈয়ার করা ও চালনা করায় কেন্দ্রীয় শক্তির ভূমিকা খুবই বড়।

ক্রমান্বয়ে বৃহত্তর কাজ করিবার জন্য স্বাবলম্বী মানুষ গ্রাম কেন্দ্র করিয়া যে প্রতিষ্ঠান গড়িবে বা গ্রাম-পঞ্চায়েৎসমূহ নিজেরা মিলিয়া যে সংগঠন গড়িয়া তুলিবে তাহাতে লেনদেন চলিবে সমানে সমানে এবং সকলের সম্মতি ভিন্ন কাজ হইবে না। এই অবস্থায় সংগঠন যতই বড় হোক না কেন শাসন করিবার বা পীড়ন করিবার ক্ষমতা কাহারও থাকিবে না। এইভাবে অপরের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ না করিয়া নিজের জীবনের উপর অধিকার বজায় রাখাই গান্ধীজীর মতে অহিংসা। বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য স্বাধীন মানুষ স্বেচ্ছায় মিলিতভাবে সমবায়মূলক কর্মানুষ্ঠানের জন্য যে প্রতিষ্ঠান গড়ে ও পরিচালনা করে তাহাই অহিংস সমাজ। গান্ধীজী বলেন অহিংস সমাজ সমসমাজ। ইহাতে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য থাকিবে না, উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের অবকাশ থাকিবে না এবং ক্ষমতাবান হইয়া উঠিয়া কেহ অপরের উপর পীড়ন করিতে পারিবে না। জীবনধারণের জন্য যাবতীয় বস্তু হইবে সর্বসাধারণের সম্পদ। সকলেরই ইহাতে সমান অধিকার থাকিবে। এইরূপ অহিংস সমাজে মানুষের মনোবৃত্তিসকল সুষ্ঠু ও স্বচ্ছন্দভাবে বিকাশ লাভ করিতে পারিবে। তাই অহিংস সমাজেই স্বরাজ পূর্ণ পরিণতি লাভ করিতে পারে।

অনেকে বলেন শোষণের অবসান ঘটাইয়া সমসমাজ গড়িতে হইলে আগে শোষক শ্রেণীর উৎসাদন করিয়া রাষ্ট্রশক্তি করায়ত্ত করা অত্যাবশ্যক। পরে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় স্বাধিকারসম্পন্ন মানুষের শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা হইবে। কিন্তু গান্ধীজী মনে করেন ভাঙা অপেক্ষা গড়ার কাজ গুরুতর। নতুন অহিংস সমাজে স্বরাজের পত্তন করিতে পারিলে কেন্দ্রীভূত শক্তিভিত্তিক রাষ্ট্র আপনা হইতেই লোপ পাইবে। গান্ধীজীর মতে স্বরাজের সাধনা গঠনমূলক কার্যক্রম দিয়া শুরু করিতে হয়। গঠনকর্ম বলিতে বুঝায় অহিংস সমাজের উপযোগী করিয়া সম্পদ ও কর্মব্যবস্থার নূতন বিন্যাস করা। গঠনকর্ম চালাইতে হইবে নিরবচ্ছিন্নভাবে, যাহাতে সম্পদ ও ক্ষমতা যেন কোনোভাবেই কেন্দ্রীভূত না হয়। রাষ্ট্রশক্তি এই কাজে সহায়ক হইতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা হইতে জাত এবং তাহার উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহারে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কিছুতেই বাদ দেওয়া যায় না। ফলে রাষ্ট্রশক্তি দখল করিয়া কাজ করিতে গেলে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা নিয়াই কাজ করিতে হয়। একের পরিবর্তে অন্যে রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রণ লাভ করিলে ক্ষমতা ব্যবহারের প্রক্রিয়া বদলাইতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা অটুট থাকিয়া যায়। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তিকে বাদ দিয়া সাধারণ মানুষের শক্তি ও শুভবুদ্ধির উপর নির্ভর করিয়া কাজ করিলে আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা ছড়াইয়া পড়িবে। সমানাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকৃত হইয়া পড়িলে দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকিবে না। স্বভাবতই সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা অবান্তর হইয়া উঠিবে। এই পরিবেশে সাধারণ মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করা সম্ভব। অতএব রাষ্ট্রশক্তি ব্যতিরেকে ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্ন গঠনকর্ম স্বরাজ সাধনার অত্যাবশ্যক অঙ্গ।

স্বরাজসাধনার অপর অত্যাবশ্যক অঙ্গ সত্যাগ্রহ। গঠনকর্মের পথে কেন্দ্রীভূত শক্তির বিরোধিতা অনিবার্য। আবার অহিংস সমাজের মধ্যেও কিছু লোকের মনে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করিবার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। গান্ধীজী বলিতেছেন নিপীড়ন ও অন্যায়ের অবসান ঘটাইতে হইবে ক্ষমতাধিকারীর হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটাইয়া। ইহার উপায় অসহযোগ, শান্ত প্রতিরোধ। অন্যায়কারীর সঙ্গে অসহযোগ করিয়া তাহাকে বুঝাইয়া দিতে হইবে যে যাহার উপর সে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাহার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ভিন্ন এইরূপ অন্যায় আচরণ করা সম্ভব নয়। প্রতিরোধ হইবে শান্ত এবং অহিংস, অর্থাৎ প্রতিরোধের কোনো পর্যায়েই যেন প্রতিরোধকারীর হাতেও ক্ষমতা সঞ্চিত না হয়। সশস্ত্র সংগ্রামে প্রতিরোধকারীর হাতে ক্ষমতা সঞ্চিত হইবার অবকাশ থাকিয়া যায়। অস্ত্রবলে অভ্যস্ত হইয়া উঠিলে সংগ্রামী প্রতিরোধকারীও একসময় নিপীড়ক হইয়া উঠিতে পারে। এক্ষেত্রে অহিংস অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইবে না। লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে নীতিগত বৈপরীত্য থাকিলে লক্ষ্যসাধন করা অসম্ভব।

কেন্দ্রীভূত শক্তির অধীনে এবং যুদ্ধের সম্ভাবনায় ক্লিষ্ট মানবসমাজ যে সংকটে পড়িয়া আছে তাহা হইতে পরিত্রাণের জন্য গান্ধীজী স্বরাজের কথা বলিয়াছেন। বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধির জন্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হইয়া আছে এবং সাধারণ মানুষ সেই প্রতিযোগিতার অংশ হইয়া উঠিয়াছে। যুদ্ধের জন্য নিরন্তর প্রস্তুতির জন্য সম্পদ ও সামর্থ্যের যে বিপুল অপচয় ঘটিতেছে তাহা রোধ করা এবং যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা হইতে মানুষকে রক্ষা করিয়া স্বাধীন ও সুখী সমাজে প্রত্যেকের নিজস্ব মনোবৃত্তিসমূহের পরিপূর্ণ বিকাশের উপযুক্ত পরিপার্শ্ব সৃষ্টি করাই স্বরাজসাধনার উদ্দেশ্য।

Post a Comment

0 Comments