Ticker

6/recent/ticker-posts

বিষদ বিষাদিনী

 

স্মৃ তি ক থা

ভাগ্যাহত এই ভূখণ্ডের হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ এই স্মৃতিকথাকে এক অমূল্য সামাজিক দলিলের মর্যাদা দিয়েছে। পূর্ববঙ্গের কথা, এই দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা মানুষদের কাছে এক বিষাদময় কথা। ‘এই গ্রন্থে পূর্ববঙ্গের যে ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা কোনও গ্রন্থেই পাই নাই।' লিখছেন রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত

বিষদ বিষাদিনী

মিহির সেনগুপ্তের "বিষাদ বৃক্ষ" গ্রন্থখানি পড়িয়া অভিভূত হইয়াছি। অভিভূত হইয়াছি বলিলাম এইজন্য যে বাংলা ভাষায় রচিত এই রকম আর একখানি

বই পড়ি নাই। এই লেখকের ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম গ্রন্থখানি পড়িয়াও আমার এই ভাব হইয়াছিল। এখন প্রশ্ন হইল এই যে ‘বিষাদ বৃক্ষ' গ্রন্থখানিকে উপন্যাস বলিব, না স্মৃতিকথা বলিব! গ্রন্থকার ইহাকে নভেল বলিয়াছেন, আমিও ইহাকে একখানি উপন্যাস বলিয়াই মনে করি। তবে উপন্যাস বিভিন্ন রকমের হইতে পারে। কোনও উপন্যাস স্মৃতিকথামূলক, কোনও উপন্যাস ঐতিহাসিক, কোনও উপন্যাস লিরিকেল, আবার কোনও উপন্যাস এপিকধর্মী। হেনরি ফিল্ডিং তাঁহার একখানি উপন্যাসকে ‘কমিক এপিক ইন প্রোজ' বলিয়াছেন। কেমব্রিজের একজন সাহিত্যের প্রফেসর লিখিয়াছেন, নভেল আধুনিক যুগের গদ্য-মহাকাব্য। ‘বিষাদ বৃক্ষ’ গ্রন্থখানিকেও আমি গদ্য-মহাকাব্য আখ্যা দিব। ইহা আমাদের কালের পূর্ববঙ্গের একখানি গদ্য মহাকাব্য। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী আমাদের সংস্কৃত মহাকাব্যকে ট্র্যাজেডি বলিয়াছেন। ‘বিষাদ বৃক্ষ’ গ্রন্থখানিও একখানি ট্র্যাজেডি। এক ইংরাজ পণ্ডিত বলিয়াছেন : 'Novel is the most protean of literary forms, is the least amenable to formal definition. '

এই গ্রন্থের শেষে মিহির সেনগুপ্ত লিখিয়াছেন : ‘এই বিভিন্নমুখি অভিঘাতের বহুমাত্রিক কোলাজ কখনও ব্যথা কখনও উল্লাসে যেন আরও গভীরে নিমগ্ন করছে আমাকে।' বিষবৃক্ষের শিকড় একটি ভাবপ্রবণ কোমল হৃদয়ে প্রোথিত। সেই হৃদয়ের কথা এই গ্রন্থে এক নিবিড় রহস্যে পরিণত। গ্রন্থখানি পড়িতে পড়িতে মনে হইয়াছে লেখকের গ্রামের ‘পিছারার খাল' যেন একটি অশ্রুর স্রোত। মিহির এই খালের কথা, অন্যান্য খালের কথা, নদীর কথা চারিদিকের বৃক্ষলতার কথা এমন সুন্দর সরল ভাষায় উপস্থিত করিয়াছেন যে পাঠকের মনে হইবে প্রকৃতিই যেন মুখর হইয়া উঠিয়াছে। এখানে গ্রন্থের ভাষা সম্বন্ধে কিছু বলিতে হয়। মিহির বহু স্থানে বাঙাল ভাষা ব্যবহার করিয়াছে। আমি বরিশালের কুলীন বাঙাল। আমি সেই ভাষা বুঝিয়াছি এবং বুঝিয়া উপভোগ করিয়াছি। তবে এই ভাষা পশ্চিমবঙ্গের ভাষার সঙ্গে বড় সুন্দর মিশিয়া গিয়াছে। কোথাও স্টাইলের বাহাদুরি নাই, কিন্তু ভাষা ব্যবহারে এক পরিশীলিত মনের পরিচয় আছে। মিহিরের স্টাইলকে আমি যথার্থ ক্লাসিক স্টাইল বলি। ভাষা যেখানে হৃদয় হইতে উৎসারিত সেখানে স্টাইল কখনও ক্ষুণ্ণ হয় না। 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গের কথা নানা মানুষের মুখে শুনিয়াছি। এ বিষয়ে দুই-একখানি গ্রন্থ পঠিত হইয়াছে। কিন্তু এই গ্রন্থে পূর্ববঙ্গের যে ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা কোনও গ্রন্থেই পাই নাই। এই স্মৃতিকথায় ভাগ্যাহত এই ভূখণ্ডের হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ এই গ্রন্থখানিকে এক অমূল্য সামাজিক দলিলের মর্যাদা দিয়াছে। পূর্ববঙ্গের কথা, এই দেশ ছাড়িয়া যাঁহারা পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছেন তাঁহাদের কাছে এক বিষাদময় কথা। তাঁহাদের দীর্ঘশ্বাস মিহির কান পাতিয়া শুনিয়াছে। গ্রন্থকার লিখিয়াছেন : ‘এই বিষাদ বৃক্ষ এবং বিষদিনী নদীর সন্তানেরা সবাই তার অংশী। আমি শুধু কথক মাত্র। এই ব্রতকথা শেষ হয়েও শেষ হবে না যতদিন না এই মহাবিষাদ বৃক্ষের অভিশাপকাল শেষ হয়।’ গ্রন্থকারের আশা এই যে এই অভিশাপ ইতিহাসের শেষ কথা নহে । একদিন হয়তো এপার বাংলা ওপার বাংলার মানুষের এমন এক হৃদয়ের উন্মেষ হইবে যে তাঁহারা এক নূতন বঙ্গের সৃষ্টি করিবে। মাইকেল তাঁহার একটি সনেটে লিখিয়াছেন : ‘জ্যোতির্ময় কর বঙ্গ ভারত রতনে’। ‘বিষাদ বৃক্ষ' লেখকের শেষ কথা : ‘বাস্তুঠাকুর আবার আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবেন এক জ্যোতির্ময় বিকাশে।


বিষাদ বৃক্ষ। মিহির সেনগুপ্ত। সুবর্ণরেখা।

কল-৯

150.00


Post a Comment

0 Comments