বিদ্যাসাগরের আজ ২০৩ তম জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
বনমালিপুরে থাকতেন ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। তাঁর পাঁচ ছেলে: নৃসিংহরাম, গঙ্গাধর, রামজয়, পঞ্চানন, রামচরণ। একান্নবর্তী পরিবার।
ভুবনেশ্বরের মৃত্যুর পর সংসারে কর্তৃত্ব করতে লাগলেন নৃসিংহরাম আর গঙ্গাধর। সংসারে ভাঙন ধরল। অবস্থা ক্রমশ এমন হয়ে উঠল যে রামজয় সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। সংসার ছেড়ে রামজয় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন, সংসারে রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী দুর্গাকে, তাঁর দুটি ছেলেকে, চারটি মেয়েকে।
কিন্তু দুর্গাও বেশি দিন থাকতে পারলেন না শ্বশুরের ভিটেয়। বাধ্য হয়ে তাঁকেও চলে আসতে হল বাপের বাড়িতে। বীরসিংহে। দুর্গা আর তাঁর ছয়টি ছেলেমেয়ে। দুটি ছেলে: ঠাকুরদাস আর কালিদাস। চারটি মেয়ে: মঙ্গলা, কমলা, গোবিন্দমণি, অন্নপূর্ণা।
দুর্গা বীরসিংহের উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের মেয়ে। উমাপতি মস্ত পণ্ডিত। তখন বৃদ্ধ হয়েছেন। সংসারে কর্তৃত্ব করেন উমাপতির ছেলে আর ছেলের বউ। অর্থাৎ, দুর্গার ভাই আর ভাইয়ের বউ।
কিছুদিনের মধ্যেই দুর্গা বুঝতে পারলেন, ভাই আর ভাইয়ের বউ খুশি হননি। কতকাল দুর্গা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে-পরাতে হবে ঠিক কী—এই ভাবনাতেই দুর্গার ভাই আর ভাইয়ের বউ বিরূপ হয়ে উঠেছেন। ভাইয়ের বউ কথায়-কথায় এমন সব কথা বলেন যাতে দুর্গার মান থাকে না।
উমাপতি একটা ব্যবস্থা করে দিলেন তখন। নিজের বাড়ির কাছাকাছি একখানা কুঁড়েঘর বানিয়ে দিলেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই কুঁড়েঘরে কায়ক্লেশে দিন কাটাতে লাগলেন দুর্গা। সুতো কাটতেন দুর্গা। সামান্য কিছু আয় হত তাতে। উমাপতি মাঝে-মাঝে কিছু কিছু সাহায্য করতেন। তবু সংসার চলে না, চলবার কথা নয়।
ঠাকুরদাসের বয়স তখন চোদ্দো-পনেরো বছর। ঠাকুরদাস সাব্যস্ত করলেন, কলকাতা যাবেন, টাকা রোজগার করবেন, মা-ভাই-বোনের দুঃখ ঘোচাবেন।
মায়ের অনুমতি নিয়ে ঠাকুরদাস চলে এলেন কলকাতায়। এলেন জগন্মোহন ন্যায়ালঙ্কারের কাছে। কাঁদতে-কাঁদতে তাঁর কাছে সব কথা বললেন, সাহায্য চাইলেন, আশ্রয় চাইলেন।
জগন্মোহনের বাড়িতে আশ্রয় পেলেন ঠাকুরদাস।
আশ্রয় তো পেলেন, কিন্তু মা-ভাই-বোনের দুঃখ দূর করার উপায় কী? একমাত্র উপায় হচ্ছে ইংরেজি শেখা। মোটামুটি ইংরেজি শিখলেই সদাগরি আপিসে কাজ পাওয়া যাবে। মা-ভাই-বোনের দুঃখ তা হলে নিশ্চয়ই দূর করা যাবে। হ্যাঁ, ইংরেজিই একমাত্র উপায়।
কিন্তু ইংরেজি শেখাবে কে? সে ব্যবস্থাও জগন্মোহন করে দিলেন। জগন্মোহনের একজন বন্ধু ইংরেজি জানেন। তিনি ঠাকুরদাসকে ইংরেজি শেখাতে রাজি হলেন।
সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরদাস ইংরেজি শিখতে যেতেন। ফিরতে রাত হয়ে যেত।
দিনের পর দিন যায়।
এক দিন সেই ভদ্রলোক ঠাকুরদাসকে জিজ্ঞেস করলেন—দিনে-দিনে তুমি এমন রোগা হয়ে যাচ্ছ কেন?
ঠাকুরদাস চুপ করে রইলেন, তাঁর দু’চোখ জলে ভরে উঠল। ভদ্রলোক পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।
যে বাড়িতে ঠাকুরদাস আশ্রিত, সন্ধ্যার পরেই সেখানে উপরি লোকের খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ হয়ে যায়। ঠাকুরদাস তখন ইংরেজি শিখতে আসেন। তাই রাত্রে আর খাওয়া জোটে না।
যাঁর কাছে ইংরেজি শিখতেন ঠাকুরদাস, তাঁর একজন আত্মীয় তখন ওখানে উপস্থিত। বৃত্তান্ত শুনে তিনি ঠাকুরদাসকে বললেন—যা শুনলাম, তোমার আর ও বাড়িতে থাকা হবে না। তুমি যদি রেঁধে খেতে পার, তা হলে আমি তোমাকে আমার বাসায় রাখতে পারি।
তাই হল।
কিন্তু এই আশ্রয়দাতার মনপ্রাণ যেমন ভাল, আয়-আদায় তেমন ভাল নয়। দালালি করতেন ভদ্রলোক। এই সময়েই আবার ভদ্রলোকের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ল। দিন চলে না। বাইরে-বাইরে ঘোরেন ভদ্রলোক, কিছু রোজগার হলে দুপুরবেলা বাসায় আসেন। দু’জনেরই কোনও দিন অর্ধাহার, কোনওদিন অনাহার। কোনও-কোনও দিন ভদ্রলোক দিনের বেলা বাসায় আসেন না। সে সময়ে ঠাকুরদাসকে সমস্ত দিন উপোস করে থাকতে হয়।
ঠাকুরদাসের সম্বলের মধ্যে আছে একখানা পিতলের থালা, একটা ছোট ঘটি। থালাখানা বিক্রি করে দিলে ক্ষতি কী? না, ক্ষতি নেই, বরং থালা বিক্রির পয়সায় খাবার কেনা যাবে। আর থালার কাজ চালানো যাবে শালপাতায়।
থালাখানা নিয়ে নতুন বাজারে কাঁসারিদের দোকানে গিয়ে উপস্থিত হলেন ঠাকুরদাস। কিন্তু সকলেই একবাক্যে ঠাকুরদাসকে ফিরিয়ে দিল। বলল—অচেনা-অজানা লোকের কাছে পুরনো বাসন কিনতে পারব না। পুরনো বাসন কিনে কখনও-কখনও বড় ফ্যাসাদে পড়তে হয়। আমরা তোমার থালা নেব না।
এক দিন দুপুর রোদে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঠাকুরদাস। বড়বাজার থেকে ঠনঠনে পর্যন্ত হেঁটে এলেন। সে দিন পেটে এককণা খাবার নেই, শরীর আর বইতে চায় না। ভেবেছিলেন, হাঁটাহাঁটি করলে ক্ষিদের কষ্ট থাকবে না, কিন্তু উল্টো ফল হল, হাঁটাহাঁটিতে আরও কাহিল হয়ে পড়লেন। একটি মধ্যবয়সী বিধবা স্ত্রীলোকের মুড়ি-মুড়কির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
স্ত্রীলোকটি জিজ্ঞেস করলেন—বাবাঠাকুর, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
ঠাকুরদাস বললেন—একটু জল খেতে চাই।
সাদরে ও সস্নেহে ঠাকুরদাসকে বসতে বললেন স্ত্রীলোকটি। বামুনের ছেলেকে শুধু জল দিলে পাপ হবে। স্ত্রীলোকটি মুড়কি দিলেন, জল দিলেন।
নিদারুণ ক্ষুধায় ব্যগ্রভাবে মুড়কি খেলেন ঠাকুরদাস। সে দৃশ্য স্ত্রীলোকটি একদৃষ্টিতে দেখলেন। বললেন—আজ বুঝি তোমার খাওয়া হয়নি বাবাঠাকুর?
—না, মা, আজ আমি এখন পর্যন্ত কিছুই খাইনি।
স্ত্রীলোকটি তখন জল খেতে বারণ করলেন ঠাকুরদাসকে। খানিক অপেক্ষা করতে বললেন। কাছাকাছি গয়লার দোকান থেকে দই নিয়ে এলেন। মুড়কির সঙ্গে দই দিয়ে পেট ভরে ফলার খেতে দিলেন ঠাকুরদাসকে।
ঠাকুরদাসের মুখে তাঁর ইতিবৃত্ত শুনলেন স্ত্রীলোকটি। জিদ করে বললেন—যে দিনই দরকার হবে, এখানে এসে ফলার করে যেও।
ঠাকুরদাস যেতেন ওখানে। দিনের বেলা যখন কিছু খাবার জুটত না, ওখানে গিয়ে পেট ভরে ফলার করে আসতেন।
নিজের দিনগুলো তো যা-হোক কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মা-ভাই-বোন? তাদের ক্লিষ্ট মুখ অহরহ চোখের উপর ভাসতে থাকে। ঠাকুরদাস একদিন আশ্রয়দাতা ভদ্রলোকের কাছে কেঁদে পড়লেন—কোথাও আমাকে একটু কাজকর্ম যোগাড় করে দিন। আমি আর পারি না। মা-ভাই-বোনের কথা মনে পড়লে আমার আর এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না।
এই ভদ্রলোক ঠাকুরদাসকে একটা কাজ জুটিয়ে দিলেন। মাইনে দু’টাকা। খুশি হলেন ঠাকুরদাস। তা বলে নিজের খরচ এক কপর্দকও বাড়তে দিলেন না। মাইনের দু’টাকাই বাড়িতে পাঠান মা-ভাই-বোনের জন্য। এ দিকে তাঁর কাজকর্ম দেখে মনিবও খুব খুশি। দু-তিন বছর পরে ঠাকুরদাসের মাইনে পাঁচ টাকা হয়ে গেল।
ও দিকে একটা মস্ত ঘটনা ঘটল এই সময়ে। সাত-আট বছর পরে ঠাকুরদাসের বাবা রামজয় সংসারে ফিরে এলেন। সংসার ছেড়ে নানা তীর্থে ঘুরেছেন এতকাল। দ্বারকায়, জ্বালামুখীতে, বদরিকাশ্রমে।
সংসারে ফিরে এসেছেন রামজয়। দেশে এসে প্রথমেই গিয়েছিলেন বনমালিপুরে। সেখানে গিয়ে দেখেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউই নেই। চলে এসেছেন তারপর বীরসিংহে।
কয়েকদিন বীরসিংহে কাটিয়ে রামজয় গেলেন কলকাতায়। বড় ছেলে ঠাকুরদাস কলকাতায় থাকে। কাজ করে।
বড়বাজারের ভাগবতচরণ সিংহের বেশ ভাল অবস্থা। রামজয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল তাঁর। রামজয়ের সমস্ত ইতিহাস শুনলেন তিনি। রামজয়কে বললেন—ঠাকুরদাসকে আমার কাছে রেখে যান।
তাই হল। ঠাকুরদাস উঠে এলেন ভাগবতচরণের বাড়িতে। ভাগবতচরণই ঠাকুরদাসকে আর একটা কাজ জুটিয়ে দিলেন। আট টাকা মাইনে। আর দু’বেলা খেতে পাওয়া যায় ভাগবতচরণের বাড়িতে।
ঠাকুরদাসের বয়স তেইশ কি চব্বিশ বছর। বিয়ে হল তখন। বিয়ে হল ভগবতীর সঙ্গে। ভগবতীর বাড়ি গোঘাটে, বাবার নাম রামকান্ত তর্কবাগীশ। ভগবতীর মামাবাড়ি পাতুলে, মাতামহের নাম পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশ।
বাঙলা হিসেবে: ১২ আশ্বিন, ১২২৭ সন; ইংরেজি হিসেবে: ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ সাল। মঙ্গলবার। সেদিন দুপুরবেলা হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঠাকুরদাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হল। হ্যাঁ, বীরসিংহ গ্রাম সে-সময়ে হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল।
ঠাকুরদাসের প্রথম সন্তানের যখন জন্ম হল, ঠাকুরদাস তখন কোথায়?
ঠাকুরদাস আহারান্তে কোমরগঞ্জে গেছেন, মঙ্গলবারের হাটে। সুখবরটা তাঁকে অবিলম্বে দিতে হয়। রামজয় অবিলম্বে কোমরগঞ্জের দিকে হাঁটাপথ ধরলেন। পথেই ঠাকুদাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
রামজয় সুখবরটা এক কথায় ভাঙলেন না। বললেন—একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে।
বাড়িতে একটা গোরুর তখন বাছুর হবার কথা। ঠাকুরদাস ভাবলেন, সেই গোরুর বুঝি একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে।
বাড়ি ফিরেই ঠাকুরদাস এগোলেন গোয়ালঘরের দিকে। রামজয় হাসতে হাসতে বললেন—ওদিকে নয়, ওদিকে নয়। এদিকে এস। এঁড়ে বাছুর দেখাচ্ছি।
গোয়ালঘরে নয়, ঠাকুরদাসকে নিয়ে আরেক ঘরে ঢুকলেন রামজয়। নবজাতককে দেখালেন। বললেন—একে এঁড়ে বাছুর বললাম কেন জান? এ এঁড়ে বাছুরের মতো একগুঁয়ে হবে। যা ধরবে তাই করবে, কাউকে ভয় করবে না।
তারপর বললেন—ও হবে ক্ষণজন্মা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, প্রথিতযশা, দয়ার অবতার। ওর জন্য আমার বংশ ধন্য হবে। ওর নাম রাখলাম ঈশ্বরচন্দ্র।
0 Comments