Ticker

6/recent/ticker-posts

আনন্দ বেদনার অশ্রু ‘ছোটদের পথের পাঁচালী'

 


প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

‘বিচিত্রা” মাসিকপত্রে ধারাবাহিক ভাবে 'পথের পাঁচালী' যখন বাহির হয় তখনই ইহা বাংলার সাহিত্যিক এবং সাহিত্য-রসিক সমাজে চমকের সৃষ্টি করিয়াছিল। পরে ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২রা অক্টোবর (১৬ আশ্বিন, ১৩৩৬,—মহালয়ার দিন) যখন ইহা পুস্তকাকারে বাহির হইল, তখন সেই প্রথম চমক স্থায়ী বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হইল। ‘পথের পাঁচালী' এক সম্পূর্ণ নূতনের, অভিনবের আস্বাদ দিল। মধ্য-বাংলার ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট, অরণ্য-নদী-সমাকুল পল্লীর শান্ত পরিবেশে একটি শিশু-কবিচিত্ত রামায়ণ-মহাভারত-কাহিনী ও যাত্রাগানের মধ্য দিয়া কেমন করিয়া ধীরে ধীরে উন্মেষ লাভ-করিয়া বিকশিত হইতেছে ‘পথের পাঁচালী'তে সেই কাহিনী চমৎকার করিয়া বলা হইয়াছে। সেই বন্য ও গ্রাম্য বালককে বিপুল উদার পৃথিবী, নদী-সরোবর-পাহাড়-পর্বত-সাগর-মহাসাগর-শোভিত ধরাপ্রকৃতি আহ্বান ও আকর্ষণ করিতেছে এবং সে ধীরে ধীরে সেই আহ্বানে সাড়া দিতেছে ; ‘পথের পাঁচালী' ও তাহার পরবর্তী অংশ ‘অপরাজিত’ তাহারই ইতিহাস। একটি বালক-মনকে কেন্দ্র করিয়া এমন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে ইহার পূর্বে আর রচিত হয় নাই ৷ লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সব মিলাইয়া প্রায় পঞ্চাশটি পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার এই সর্বপ্রথম-প্রকাশিত ‘পথের পাঁচালী'ই তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলিয়া গণ্য হইয়াছে। ‘ছোটদের পথের পাঁচালী' সেই বৃহৎ উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।

১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর, বুধবার, বেলা সাড়ে দশটায় (২৮ ভাদ্র, ১৩০১)

কাঁচড়াপাড়া-হালিসহরের সন্নিকটে মুরাতিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে বিভূতিভূষণের জন্ম হয়। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় পৌরোহিত্য ও কথকতা করিয়া সংসার-যাত্রা নির্বাহ করিতেন। তাঁহার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের জন্য দূরদূরান্ত হইতে তাহার ডাক আসিত। বালক বিভূতিভূষণ পিতার সহিত নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া ফিরিতেন। ইহা হইতেই তাহার ধর্মে মতি ও ভ্রমণে আসক্তি জন্মিয়াছিল। মহানন্দের পিতামহ আদি নিবাস চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রাম ত্যাগ করিয়া কবিরাজি ব্যবসায় করিবার জন্য যশোহর জেলার বনগ্রাম মহকুমার বারাকপুর গ্রামে বসবাস আরম্ভ করেন। সেই হইতে তাঁহারা বারাকপুরের অধিবাসী। বিভূতিভূষণের মাতা মৃণালিনী দেবীর পিত্রালয় ঘোষপাড়া-মুরাতিপুর। বিভূতিভূষণ পিতামাতার প্রথম সন্তান। অতিশয় দারিদ্র্য ও অনটনের মধ্যে তাঁহার শৈশব অতিবাহিত হইয়াছিল। সংসারের প্রতি মহানন্দের উদাসীনতা হেতু মৃণালিনীকে বহু কষ্টে ও কৌশলে সংসার চালাইতে হইত। দুমুঠা অন্ন কোনও প্রকারে জুটিত, কিন্তু পাল-পার্বণে ভালমন্দ খাবার তিনি ছেলেমেয়েদের মুখে তুলিয়া দিতে পারিতেন না। ‘পথের পাঁচালী'র সর্বজয়া-চরিত্রে তাঁহার দুঃখ-বেদনার ইতিহাস আছে। তাঁহার চিরবঞ্চিত সন্তানদের সুখাদ্য-লোলুপতার কথা "অপুর কাহিনীতে ফুটিয়া উঠিয়াছে। মহানন্দের জ্ঞাতি-ভগিনী বিধবা মেনকা দেবী ভ্রাতার সংসারেই জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনিই ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দির ঠাকরুণ।

গ্রামের পাঠশালায় পাঠ সাঙ্গ করিয়া বিভূতিভূষণ বনগ্রামে পরের আশ্রয়ে থাকিয়া বহুকষ্টে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন (১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দ) ও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে রিপণ কলেজ হইতে ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে আই-এ ও ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে বি-এ পাস করিয়া শিক্ষা-জীবন শেষ করেন। এই সময়েই তিনি বিবাহ করেন। অত্যল্পকাল মধ্যেই তিনি বিপত্নীক হন।

বিভূতিভূষণের চাকুরি-জীবন অতি বিচিত্র—ইস্কুলমাস্টারি দিয়া আরম্ভ করিয়া গোরক্ষিণী সভার ভ্রাম্যমাণ প্রচারক, ভাগলপুর জমিদারী এস্টেটে নায়েব-তহশিলদার ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মের শেষে তিনি শেষবয়সে আবার ইস্কুলমাস্টারিই করিতে থাকেন। চাকুরি-জীবনের নানা দেশ ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁহার সাহিত্য-জীবনের বিবিধ উপকরণ জোগাইয়াছিল।

১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর ফরিদপুরের শ্রীষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা রমা দেবীর সহিত তাঁহার দ্বিতীয় বিবাহ হয়। বিধবা রমা দেবী ও একটিমাত্র পুত্রসন্তান বাল্লুকে রাখিয়া বিভূতিভূষণ ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর রাত্রি ৮টা ১৫ মিনিটের সময় ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স ৫৬ বৎসর পূর্ণ হইয়াছিল।

দরিদ্র ও অস্থির জীবনের মধ্যেই বিভূতিভূষণ নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার সহিত সাহিত্য-সাধনা করিয়াছিলেন এবং জীবনে চরম সিদ্ধিলাভও করিয়া গিয়াছেন। হরিনাভি স্কুলের শিক্ষকতা করিবার কালে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে রচিত একটি গল্প ‘উপেক্ষিতা’ ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (মাঘ, ১৩২৮) প্রকাশিত হয়, সেইদিন হইতে তাঁহার প্রকাশ্য সাহিত্য-জীবন আরম্ভ। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্তও তিনি সাহিত্য-সেবা করিয়া গিয়াছেন।

তাঁহার রচিত পুস্তকগুলির মধ্যে কয়েকটি উপন্যাস—পথের পাঁচালী, অপরাজিত, দৃষ্টি-প্রদীপ, আরণ্যক, অনুবর্তন, দেবযান ও ইছামতী প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। মেঘ-মল্লার, মৌরীফুল, জন্ম ও মৃত্যু প্রভৃতি গল্পসংগ্রহের পুস্তকও রসিকজনের প্রশংসা লাভ করিয়াছে। শিশুসাহিত্যেও তাঁহার দান সামান্য নহে। 

শ্রীসজনীকান্ত দাস

পথের পাঁচালী নিয়ে ... 

পথের পাঁচালীর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ ও তাঁর অনুজ নুটু বিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের বিবাহের পরেও বহুদিন অপুত্রক ছিলেন। সে সময়ে অনেকেই বলতেন, তোমাদের বংশের এ অবস্থা, (অর্থাৎ দুভাই-ই সন্তানহীন) এ কেমন হল?-

আমাদের দু'জায়ের মনও খুব ভারাক্রান্ত হত এ কথা শুনে। সত্যিই কি এরপর কেউ থাকবে না বাঁড়ুজ্জে গোষ্ঠীতে? ঠাকুরপো নানারকম রসিকতা করত আমাদের দু’বউকে নিয়ে। বলত—এরপর তোমাদের দেখলেও কিন্তু অযাত্রা হবে বউদি।

এসব কথা বলার এখানে প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু পথের পাঁচালীর ওপর ওঁর কেমন গভীর ভালবাসা ছিল তা বলবার জন্যই এ কথাকটির অবতারণা।

আমি মাঝে মাঝে আমাদের বংশের সন্তানহীনতার কথা ওঁর কাছে ব্যক্ত করলেই উনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন—কেন, পথের পাঁচালীই তো তোমার ছেলে। সে এখন উপযুক্ত, তোমার তৈরী সন্তান এসব কথা আমাদের পুত্র তারাদাসের জন্মের সাত বছর আগেকার ঘটনা।

সত্যি, পথের পাচালী আমাদের বুক জুড়ে রয়েছে। শুধুই আমার নয়, আমাদের বংশের সকলেরই। বৌমা, বাবলু, আমার দুই নাতি, আমার পরম বান্ধবী সমা,আমার জা যমুনা, আমরা সকলেই জানি আমাদের সুখে, আমাদের দুঃখে, আমাদের বিপদে, আপদে, সম্পদে, পথের পাঁচালী আমাদের সব। মনে পড়ে, পথের পাঁচালীর স্রষ্টার কথা। এমন শান্ত, ব্রহ্মজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ, নির্লোভ, ত্যাগী, বিনীত, অসমসাহসী, সবই গুণান্বিত লোক আমি খুব কমই দেখেছি। তাঁর প্রকৃতিকে ভালবাসার কথা তো প্রায় প্রবাদবাক্যের মতই হয়ে গেছে।

এখানে দু'একটি ঘটনা বলি। প্রতিবারই ঘাটশীলা থেকে দেশে এসে দেখতাম, আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে ঘরদোর, উঠোন, বাগান। যথারীতি লোক লাগানো হত বন কাটানোর জন্য। আমি ও পাশের রান্নাঘর থেকে শুনতাম উনি বলছেন—ওরে ও গাছটা কার্টিসনে। আরে, ওগুলো রাখ। সবই যে সাফ করে দিলি।

একটু পরেই আবার শুনি উনি হাঁ-হাঁ করে উঠছেন—আরে—আরে! সর্বনাশ করিসনে! এখুনি দিয়েছিলি সেরে! ওতো সোঁদালী গাছ! ও কি কাটতে আছে? তামাকের আগুন চাইতে এসে পুরে (গ্রামের কৃষাণ) বল্ল- কি কাটব কাকীমা, কাকা শুধুই বলছেন এ কাটিসনে, ও কার্টিসনে। আমি বল্লাম—ওই অমনি, ওপর ওপর যা হয় কর। ওঁর মনে ব্যথা দিসনে–

একবার দেশে এসে দেখি, কি এক লতায় রান্নাঘরের জানালাটা ছেয়ে ফেলেছে। আমি ওঁকে বল্লাম—দেখ, লতাটা কাটিয়ে দাও। পোকা মাকড় আসতে পারে। তাছাড়া, লতাটা মনে হচ্ছে বিছুটীর। হাত চুলকুচ্ছে খুব। উনি লতাটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বল্লেন—একটু সাবধানে কাজ করাতে পারবে না তুমি?

দেখ, কি সুন্দর লতাবিতান তৈরী হয়েছে। রাখতে পারবে না কল্যাণী?

রয়ে গিয়েছিল সেই গাছ। নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলের ওপর নুয়ে পড়াবাবলা গাছের ডাল বেয়ে ওঠা লতাবিতানের তলায় বসে উনি ভগবানের গভীর সান্নিধ্য উপলব্ধি করতেন। নদীর ওপারের মাঠ, পুবের চরে নলখাগড়ার ঝোপে পড়ত অস্ত সূর্যের গোলাপী আলো, পড়ত সাঁই বাবলা গাছেও। সাঁই বাবলার শুভ্র কাণ্ড রঙীন হয়ে উঠত গোধূলীর আলোর আভায়।

প্রতি সন্ধ্যায় স্নানান্তে জলে দাঁড়িয়ে ওই নল খাগড়ার বন ও সাঁই-বাবলা গাছটির দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা-বন্দনা করতেন উনি। পৈতে জড়ান হাতে থাকত অঞ্জলিভরা জল।

এমন মুহূর্তে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তিনি যে একাত্মতা অনুভব করতেন, তাই তাঁর সাহিত্যে বিধৃত হয়ে আছে।

পথের পাঁচালী-র পথ পরিক্রমা আবার নতুন দিক পরিবর্তন করেছে। সেই নতুন পথের দুপাশের ফল, ফুল পুষ্পের শোভায় আবার সকলেই পুলকিত হবেন আশা করি।

বর্তমান সংস্করণের প্রকাশকেরা নতুন উদ্যম নিয়েছেন, আবার শুভ প্রচেষ্টায় হাত দিয়েছেন। আমি এঁদেরই একজন, আমার পরিবারের সকলেও এঁদের প্রচেষ্টার সঙ্গে একাত্ম। হৃদয়ের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা সহ।

বিনীত 

রমা বন্দ্যোপাধ্যায়

যাদের ছবিতে বইটি সাজানো

কেয়া চট্টোপাধ্যায়, রাজসী সোম, দেবব্রত দত্ত, অত্রী ধর্মন, সোমা মুখোপাধ্যায়, অতনু নন্দী, অনুপা দাস, জয়তী বিশ্বাস, দীপা চট্টোপাধ্যায়, এনা বিশ্বাস, দেবমাল্য দে, দীপাঞ্জন দেব, পিনাকী মজুমদার, দোলা চক্রবর্তী, তাপস পাল, মহুয়া রায়, শৌভিক হালদার, শোভনা দাঁ, তন্ময় মান্না, অনির্বাণ বিশ্বাস, সায়নী চট্টোপাধ্যায় তন্ময় সামন্ত, সুজাতা চক্রবর্তী, সুদীপ্ত রায়, কিংশুক কড়োরি, অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ন্তনী সেনগুপ্ত, বিপ্লব দেব, সম্পূর্ণা সাত্তার, সূর্যব্রত চট্টোপাধ্যায়, তিলক রায়চৌধুরী, ভাস্করমণি সাহা, মধুমতি বসু, সুমন সেন, দেবমালা যশ, সুলক্ষণা নন্দী, রমা তা, প্রীতম রায়, সুমা সাধুখাঁ, ভাস্কর চক্রবর্তী, লোপামুদ্রা চট্টোপাধ্যায়, পৌষালী বসু, সুচেতা মল্লিক, অমিত মণ্ডল, বাপ্পাদিত্য সিংহ, শতশ্রী রায়চৌধুরী, কল্লোল রায়, তপতী চৌধুরী, সুতপা চট্টোপাধ্যায়, সৌমিক রায়চৌধুরী, মহুয়া দে, দেবমালা মধুছন্দা দেব, সুমিত ঘোষ, কৌশিক গুহঠাকুরতা, বিশ্বজিৎ পাল, সুরজিৎ গাঙ্গুলী, কাজরী হাজরা, রূপশ্রী দত্ত, সুলক্ষণা নন্দী, অঞ্জন বিশ্বাস, মালিনী ধর এবং সর্বাণী দাস ।


Post a Comment

0 Comments