Dhaka Street at Night Illustrated by riton.ai
ঢাকার রাস্তার নামকরণ
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউটি কোন জায়গায় বলতে পারবেন? বা বংশী চন্দ্র সেন পোদ্দার রোড বা সুবল চন্দ্র দাস রোড? এসব রাস্তায় যারা বসবাস করেন তারা ছাড়া আর কেউ যে এগুলোর হদিস জানাতে পারবেন না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু যদি বলি তাঁতিবাজার বা লালবাগ তাহলে নিশ্চয় চিনবেন। তাঁতিবাজার ও লালবাগের রাস্তা দুটির নামকরণ করা হয়েছিল বংশী চন্দ্র ও সুবল চন্দ্রের নামে।
ঢাকার রাস্তাঘাটের নামকরণের ব্যাপারে সঠিক কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়েছিল বলে জানা নেই। ঐতিহাসিক কারণে কিছু কিছু অঞ্চলের নামকরণ হয়েছিল। প্রাক মুঘল যুগে আমরা পাই এ ধরনের নাম, যেমন বাংলাবাজার, ঢাকেশ্বরী, পুশত-ই-কিলা (পোস্তগোলা) প্রভৃতি। মুঘল আমলে আবার পেশাজীবীদের বসবাসের কারণে নামকরণ হয় অনেক অঞ্চলের। যেমন-আজিমপুর, নবাবপুর, বখশীবাজার, তাঁতিবাজার, ইসলামপুর প্রভৃতি। প্রাক-মুঘল বা মুঘল যুগে রাস্তাঘাটের নামকরণের ব্যাপারটি ছিল না কারণ, সেই অর্থে ঢাকা শহরে তখন রাস্তাঘাট ছিল না। ইংরেজ আমলে, যখন পৌরসভা স্থাপিত হয় এবং একটি-দুটি রাস্তা হতে থাকে তখন নামকরণের প্রশ্নটি দেখা দেয়। ঢাকার রাস্তার নামকরণের বিষয়টি প্রাধান্য পায় এ শতকের শুরু থেকে। সে থেকে গত শতকের ষাট দশক পর্যন্ত বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে এবং এতে প্রতিফলিত হয়েছে এক একটি সময়ের এলিটের মনোভঙ্গি।
ঢাকার রাস্তার নামকরণ নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। এবং কেন ও কিভাবে নামকরণ হবে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে কিনা তাও আমাদের অধিকাংশের জানা নেই। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত আজিমুশশান হায়দারের ষাট পৃষ্ঠার বই ঢাকা : হিস্ট্রি অ্যান্ড রোমান্স ইন প্লেস নেমস-ই ঢাকার রাস্তার নামকরণের ব্যাপারে আমাদের একমাত্র অবলম্বন।
হায়দার জানাচ্ছেন, পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকার নামকরণের ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, পদে থাকাকালীন জনপ্রতিনিধি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নামে কোন এলাকার নামকরণ করা যাবে না। রাষ্ট্রপ্রধানের নামে করা যেতে পারে তবে আগে তার অনুমতি নিতে হবে। রাষ্ট্র প্রধানের নামে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যতীত রাস্তার নামকরণ করা যাবে না। নতুন কোনো এলাকার নামকরণ হয়তো কোনো ব্যক্তির নামে করা যেতে পারে যদি ঐ এলাকা গড়ে তোলার ব্যাপারে তার বিশেষ অবদান থাকে। ঐ নীতিমালায় আরও বলা হয়েছিল, ঔপনিবেশিক আমলে যেসব নামকরণ করা হয়েছে উপনিবেশের স্মৃতি রক্ষার্থে সেগুলোর নাম বদলানো যেতে পারে। তবে, যদি এমন কেউ হন যার শিক্ষা বা সমাজ ক্ষেত্রে অবদান আছে সে নাম থাকতে পারে। নীতিমালা একটি হয়েছিল বটে কিন্তু মানা হয়নি। তেমনি ১৯৪৭ সালের আগে পর্যন্ত পৌরসভাকে সামান্য কিছু টাকা দান করে অনেকের নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ঐ সময় অনেক ক্ষেত্রে যে এলাকা/রাস্তার সঙ্গে ইতিহাসের স্মৃতি জড়িত তার নাম বদল হয়েছে কিন্তু সাধারণ মানুষ তা মেনে নেয়নি এবং সেসব নাম খাতাপত্রে আছে, মানুষের মনে নেই, থাকে না। জোর করে নাম বদলাতে গেলে বা যে নাম নানা কারণে পরিচিত হয়ে উঠেছে তা বদলাতে গেলে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শাসকরা অবশ্য তা বোঝে না। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ ‘ঢাকা' নামের ক্ষেত্রে। ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকার নামকরণ করলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে-জাহাঙ্গীরনগর। ঐ নাম শুধু খাতাপত্রেই টিকে ছিল। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে এই ধরনের নামকরণের ঝোঁক দেখা যায়। আইয়ুব খানের সময় হয় আইয়ুব নগর। সেটি কোথায় কেউ জানে না। জিয়া উদ্যান, রওশন উপজেলা টেকেনি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তাব থাকবে এলাকা, প্রতিষ্ঠান বা রাস্তার নামকরণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে তা প্রকাশ করা হোক। যাতে শাসক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নামকরণের হিড়িক না পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যেন আমরা খানিকটা সংযম দেখাতে পারি।
ঢাকার রাস্তার নামকরণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আগে ছিল পৌরসভার। আগেই উল্লেখ করেছি, ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণ কিভাবে হয়েছিল ঐতিহাসিক কারণে। মুঘলদের পর, কোম্পানি আমলে কিছু নামকরণ হয়েছিল যেমন- ফরাশগঞ্জ, আর্মেনিটোলা, তোপখানা, পল্টন প্রভৃতি। হায়দার জানাচ্ছেন, ১৯২০-৪৫ সালের মধ্যের সময়টা ছিল সবচেয়ে ঝামেলার। বিত্তশালীরা সামান্য কিছু টাকা পৌরসভাকে দিয়ে ব্যক্তির নামে রাস্তার নামকরণ করিয়েছে।
আমরা মনে করি ঢাকার যেসব রাস্তার সঙ্গে ইতিহাসের স্মৃতি জড়িত সেগুলোর নামকরণ কোনোভাবেই বদলানো উচিত হবে না। যেমন- ফরাশগঞ্জ, মগবাজার, আর্মেনিটোলা বা মনিপুরিপাড়া। মুঘল আমলে গড়ে উঠেছে যেসব পেশাজীবীদের এলাকা সেসব এলাকার ভিতর দিয়ে যেসব রাস্তা গেছে সেগুলোর নামকরণ ঐ এলাকার নামেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন- শাঁখারী বাজার, কাগজীটোলা, যোগীনগর বা টিকাটুলি। মুঘল আমলে অনেক ব্যক্তির নামে এলাকার নামকরণ হয়েছে সেগুলো এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। যেমন- আগাসাদেক রোড বা বেগম বাজার রোড। এগুলো সেভাবেই থাকতে পারে। ভূপ্রকৃতির কারণে যেসব নামকরণ হয়েছে সেগুলোর নামও বদলানো যাবে না। যেমন- ধানমন্ডি, সেগুনবাগিচা, বাদামতলী, রমনা বা ফুলবাড়িয়া। ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার বা ব্রিটিশ লাট-বেলাটের নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে কোনো ইতিহাস বা ব্যক্তির অবদান জড়িত নেই। এগুলো হলো- স্যাভেজ রোড, ওয়্যার স্ট্রিট, হার্নি স্ট্রিট, ফ্রেঞ্চ রোড, ইংলিশ রোড, লারমিনি স্ট্রিট; সিমসন রোড, মিন্টো রোড, জনসন রোড, রয়্যাল স্ট্রিট, র্যাংকিন স্ট্রিট, বাকল্যান্ডবাঁধ, হেয়ার রোড, ফুলার রোড, ওয়ালটার্স রোড ও মিটফোর্ড রোড। এদের মধ্যে ঢাকার জন্য অবদান আছে ওয়ালটার্স, বাকল্যান্ড ও মিটফোর্ডের। এই তিনজনের নামে রাস্তা তিনটি থাকতে পারে। বাকি নামগুলোর নাম অনেকের কাছে এখন অচেনা। এগুলো রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই ৷
১৮৬৪-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অনেক রাস্তার নামকরণ হয়েছে টাকার বিনিময়ে। কিছু নামকরণ হয়েছে এলাকায় তাঁর অবদান স্মরণ করে। হায়দার এ ধরনের ৬০টি রাস্তার নামের তালিকা করেছেন। এ মধ্যে একটা বড়ো অংশ বাদ দেওয়া যেতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ দিই। সোনারতলির নামকরণ করা হয় মনোহর রায় লেন। এর জন্য দান করা হয় ৩০০ টাকা। অথচ সোনারতলি নামটি ঐতিহাসিক। ১৯২১ সালে ২৫০ টাকার বিনিময়ে কোতোয়ালি রোডের নামকরণ করা হয় হরিপ্রসন্ন মিত্র রোড। ১৯২০ সালে চাঁদনীঘাট রোডের নাম হয়ে যায় কামিনীভূষণ রুদ্র রোড। এ ধরনের রাস্তার নাম থাকার যৌক্তিকতা নেই আবার দীননাথ সেন রোড থাকা উচিত কারণ গেন্ডারিয়ার পত্তন তিনি করেছিলেন। সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন ঘোষের নামে যে রাস্তা তা থাকাও বাঞ্ছনীয়। নবাব গনি বা আহসানউল্লার নামে রাস্তাও, কারণ ঢাকা শহরের জন্য তাঁদের দান সবচেয়ে বেশি।
১৯৪৭-এর পর এমন সব নামকরণ করা হয় যার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের কোনো যোগ নেই। যেমন-তাজমহল, বাবর, শেরশাহ, আওরঙ্গজেব রোড প্রভৃতি। উর্দুভাষী শাসকরা তাদের ভাষায় ইসলামীকরণের যে প্রক্রিয়া চালু করেছিল এগুলো তারই ফল। এসবের নাম বদল করা হোক। ঢাকায় আবার কিছু রাস্তা আছে যেগুলোর সুন্দর নামকরণ করা যেতে পারে। যেমন- সার্কুলার রোড বা পার্ক অ্যাভেনিউ। এগুলো তেমন পরিচিত নয়।
সবশেষে বলবো, ঢাকার রাস্তার নামকরণের ক্ষেত্রে অবিলম্বে সিটি করপোরেশনের নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। দ্বিতীয়ত, পর্যালোচনা করে ঢাকার অনেক রাস্তার পুনঃনামকরণ করা উচিত। তৃতীয়ত, ঢাকার অনেক রাস্তার নতুন নামকরণ বাঞ্ছনীয়। এ নামকরণ ব্যক্তির নামে নাও হতে পারে। জেনারেল এরশাদকে যতো অপছন্দই করি না কেন, তিনি এ ধরনের দুটি সুন্দর নাম দিয়ে গেছেন- পান্থপথ ও বিজয় সরণি। সবশেষ প্রস্তাব, আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষে ৩ নভেম্বর জেলে নিহত চার নেতার নামে এবং বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী- সাহিত্যিক যেমন— কামরুল হাসান, হাসান হাফিজুর রহমান বা আহসান হাবিবের নামে কিছু রাস্তার নামকরণ করা হোক। যেসব এলাকায় শহীদ কোনো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং সে এলাকার রাস্তার নাম (যদি ঐতিহাসিক বা অন্য কোনো ক্যাটাগরিতে না পড়ে) তাঁর নামে করা যেতে পারে। আমরা চাই ঢাকার রাস্তার নামকরণে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এসব রাস্তার নামকরণে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের ছায়া প্রতিফলিত হোক।
তবে, ঢাকাবাসী নিশ্চিত জেনে রাখুন, এর কিছুই হবে না। আমাদের কর্তাব্যক্তিদের এসব নিয়ে ভাববার সময় নেই। আর করপোরেশনের আমলারা প্রথমেই ঐতিহ্য মতো সব প্রস্তাবে বলবেন, না। সবচেয়ে বড়ো কথা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভাব যেটির, সেটি হচ্ছে-বোধ। বোধ না থাকলে সংস্কৃতির বিকাশ একটু কষ্টকর বৈকি!
মুনতাসীর মামুন
0 Comments